সিজারের নামে চিকিৎসক নামক কসাইদের ব্যবসা যত্রতত্র প্রসুতির মৃত্যুর ঘটনা : ভুক্তভোগী পরিবারে নেমে আসছে অমানিশা অন্ধকার : আইনের ফাকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন হোতারা

0

বি এম আসাদ ॥ ভবিষ্যতে সুখের প্রত্যাশা নিয়ে অতি কষ্ট সহ্য করার পর মায়েরা সন্তান জন্ম দেন। আর সেবার মানসিকতা নিয়ে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করার মাধ্যমে মায়ের সন্তান প্রসব করানোর মহান দায়িত্ব বর্তায় চিকিৎসকদের উপর। কিন্তু বর্তমানে চিৎিসক সেবার সেই মহান দায়িত্ব পালন না করে এটিকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেছেন এক শ্রেণীর অর্থলোভী চিকিৎসক। রোগী পেলেই তারা গুণ বিচার না করেই অর্থের লোভে যত্রতত্র রোগী পেলেই অপারেশন করছেন। এতে করে প্রস্যুতি মায়ের মৃত্যু বেড়ে যাচ্ছে। যশোর ও ঝিনাইদহ জেলায় এতে করে প্রস্যুতি মায়ের মৃত্যু সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিজারের রোগী যোগাড় করার জন্য তারা কম মূল্যে প্যাকেজ ঘোষণা ও কমিশনভিত্তিক দালালের আশ্রয় নিয়েছেন। এ পরিস্থিতি বন্ধ করার জন্য যশোরের সিভিল সার্জন উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ২নং বেডে চিকিৎসাধীন সুমাইয়া খাতুন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। সুমাইয়া খাতুন ঝিনাইদহের হাতিমপুর গ্রামের ভ্যানচালক আলামিনের স্ত্রী। গত মঙ্গলবার (২৫ জুন) বিকেলে ঝিনাইদহ শহরের পাগলা কানাই এলাকায় শহদি মশিউর রহমান সড়কে অবস্থিত বেসরকারি হাসান ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে তেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রোগীর শারীরিক অবস্থা না বুঝেই সুমাইয়াকে সিজার করেন। ওই ক্লিনিকের মালিক হচ্ছন প্রফেসর ডাঃ মোঃ হাসানুজ্জামান। রোগীকে অপারেশন করার পর সুমাইয়া প্রথম পুত্র সন্তান লাভ করেন। এরপর রোগীর অপারেশন সফর না হওয়ায় রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সেখানে একদিন থাকার পর ২৬ জুন বুধবার তার অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। এক পর্যরায়ে অপারগতা প্রকাশ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রসুতি সুমাইয়াকে যশোর আদ্বদীন হাসপাতালেও অবস্থার কোন উত্তরন ঘটেনি অল্প বয়সে মা হতে যাওয়া সুমাইয়া খাতুনের। অবস্থা বেগতিক দেখে মুমুর্ষু অবস্থায় এদিন ২৬ জুন বিকেল সাড়ে ৩টায় তাকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরপর সাথে সাথে তাকে নেয়া নিবীড় চিকিৎসা পরিচর্যা কেন্দ্র আইসিইউতে। বর্তমানে আইসিউ বিভাগের ২নং কেবিনে সুমাইয়া খাতুন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। রোগীর স্বামী আলামিন ও শাশুড়ি আঞ্জুয়ারা বেগম জানিয়েচেন ওই হাসান ক্লিনিকে ভর্তি করার পরপরই ডাক্তার তালে অপারেশন করেন। অপারেশনের পর এক পুত্র সন্তান পেয়ে খুশিতে তাদের বুক ভরে যায়। কিন্তু পরের দিন রোগীর রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং খেঁচুনি ওঠে। তখন তাকে (সুমাইয়াকে) প্রথম যশোর আদ্বদ্বীন হাসপাতাল ও পরে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একজন গরিব ব্যান চালকের পক্ষে এমন বিপদ সামাল দেয়া কস্টকর বলে জানিয়েছেন তারা।
ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে প্রায় ঘটে প্রস্যুতি মায়ের মৃত্যুর ঘটনা। ঝিনাইদহের মতো যশোর শহর সহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঘটছে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা। গত ২৫ জুন রাত ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডে কাজল (২৩) নামে এক প্রসুতি মায়ের মৃত্যু হয়েছে।
মৃত্যুর ৫৩ মিনিট আগে শহরের একটি বেসরকারি পরিচিত হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর দায় এড়ানোর জন্য রাত ৪টা ৭ মিনিটে দ্রুত তাকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। মৃত কাজল যশোর সদর উপজেলার এনায়েতপুরের আব্দুল হাকিমের স্ত্রী। ওই হাসপাতালে যশোর মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ ফারজানা তাকে রাত আড়াইটার দিকে করা হয়েছিল।
গত ২৪ জুন সদর উপজেলার রূপদিয়া বাজারে গ্রামীণ ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সিজার করতে গিয়ে মারা যান সীমা খাতুন (২৫) নামে এক গৃহবধূ। সীমা খাতুন নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের আন্দুলিয়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের স্ত্রী। মৃতার স্বজন রাজিবুল ইসলাম জানিয়েছেন, রোগী ছিল আদ্বদীন হাসপাতালের। গর্ভবতীর মেয়াদ ৩৬ সপ্তাহ পূর্ণ হলে গ্রামীণ ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মহিলা দালাল আন্দুলিয়া গ্রামের জুলফিকার আলীর স্ত্রী সালেহা খাতুন বাড়ি থেকে রোগীকে ওই ক্লিনিকে আনেন। রোগী আনা বাবদ ক্লিনিক মালিকের কাছ থেকে ১ হাজার ২শ’ টাকা পেয়েছেন। রোগী ক্লিনিকে আনার সাথে সাথে কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা না করেই ডাঃ জামান ও ডাঃ সালেহা নুর তুলি রোগীকে সিজার করেন। সিজারের টেবিলেই তার মৃত্যু হয়। তখন রোগীর লোকজন ক্লিনিকে এসে পৌঁছাইনি। স্বামী রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি ক্লিনিকে আসার সাপথে সাথে দেখতে পান অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর তার স্ত্রী। নিস্তেজ হয়ে আছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে রোগীর সাথে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় ক্লিনিক মালিক। ডাঃ জামান হচ্ছে পল্লী চিকিৎসক। তার স্ত্রী ডাঃ সালেহানুর হচ্ছেন নবীন মেডিকেল অফিসার। এমবিসিএস পাশ করেছেন। ডাক্তারিতে যশ অর্জন করতে পারার আগেই ক্লিনিক খুলে ব্যবসা শুরু করেছেন। যার হাল নাগাদ কোন নিবন্ধন নেই। এ ক্লিনিকে কম টাকায় প্যাকেজ ও দালারে কমিশন দিয়ে রোগী সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুধু এটি নয় যশোর শহরের হাতে গোনা ৩/৪ট সুপরিচিত ডায়াগনস্টিক মেডিকেল সার্ভিসেস ও বেসরকারি হাসপাতাল চাড়া সব বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কমিমন ভিত্তিক চুক্তিতে রোগী সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। যা স্বাস্থ্যনীতির চরম লঙ্ঘন। মায়েরা দীর্ঘ ৯ মাস ১০দিন চরম কষ্ট স্বীকার করে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে সন্তান জন্ম দেন। তাদের এ সন্তান প্রসব করানোর নামে এক শ্রেণীর চিকিৎসক এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চিকিৎসা সেবার নামে ব্যবসা শুরু করেছেন এবং সন্তান প্রসব করানোর নামে নিঃষ্পাপ প্রাণগুলো অকালে ঝরে যচ্ছে চিকিৎসক নামের ব্যবসায়ী এক শ্রেণীর কসাই নামক চিকিৎসকের কারণে। বড় বড় সার্টিফিকেটধারী চিকিৎসকদের ভুলের কারণে। অথচ চিকিৎসক হওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের চিকিৎসক কর্মকর্তাগণ তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত কঠোর পদক্ষেপ নেন না। ফলে অকালে ঝরে যাওয়া প্রসুতি মা’েদের মূল্যবান জীবনহানীর করুন কাহিনীর তেমন বিচার হয় না। এতেকরে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোতে নেমে আসছে অমানিশা অন্ধকার বিরাজ করছে। এ অবস্থার মধ্যে নানারকম তদ্বিরের মাধ্যমে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে প্রসুতির সিজার কাজে নিয়োজিত নামধারী চিকিৎকরা বের হয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য নীতিতে আইনের দুর্বলতার কারণে সর্বত্রই হরহামেশাই একের পর এক ঘটছে প্রসুতি মায়ের মৃত্যুর ঘটনা।
যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের প্রসুতি ওয়ার্ড বা লেবার ওয়ার্ডের রোগীর মৃত্যু খাতার এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত ৬ মাসে এ ওয়ার্ডে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে ১০ জন প্রসুতি মায়ের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যশোর শহর ও পল্লী অঞ্চলে জেলায় এ মৃত্যুও সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে বিশেষজ্ঞগণ জানিয়েছেন। যশোর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সিভিল সার্জন হচ্ছেন এসব বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা। যশোরের নবাগত সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ মাহমুদুল হাসানের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তিনি অধিক সংখ্যক প্রসুতি মাতৃ মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করন এবং বলেন, এ সকল ঘটনা স্থাস্থ্য আইনের চরম লঙ্ঘন। তিনি কঠোর হস্তে এসব দমন করবেন। ইতিমধ্যে রূপদিয়ার গ্রামীণ ক্লিনিক বন্ধ ও তালাবদ্ধ করে দিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, অতিসত্ত্বর এ ব্যাপারে মেডিকেল কলেজ, ২৫০ শয্যা হাসপাতালসহ সব চিকিৎসকরে নিয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হবে। যাতে কেউ অন্যায় করে আইনের কবল থেকে বের হতে না পারে। যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ হারুন অর রশদি বলেন, অবস্তা খুবই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। শহরের বাইরে আরো বেশি হবে। এ অবস্থা বন্ধ হওয়া দরকার।
মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক গাইনি ডাঃ রেবেকা সুলতানা দিষা বলেন, একজন গর্ভবতী মাকে অপারেশন বা সিজার করতে হলে সব দিক সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে হলে সব দিক সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে হবে। যত্রতত্র সিজার করা যাবে না। তাতে রোগীর ক্ষতি হয়। আবার রোগীরও দোষ আছে তারা কম টাকা খরচের জন্য যেখানে সেখানে চলে যায়। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে টাকা কম খরচ হয়। সেখানে রোগীর যাওয়া উচিৎ বলে মন্তব্য করেন ও চিকিৎসক।