জামিন নামঞ্জুর : অমিতসহ ৫১ নেতা-কর্মী কারাগারে ঈদ আনন্দে বিষাদের সুর ৫১টি পরিবারে

0

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ রোববার জেলে পাঠানো হয়েছে ৫১ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে। গত ২৮ অক্টোবর বিরোধীদলের নির্বাচন বর্জনের ডাকে রাজধানীর নয়াপল্টনে সমাবেশ কর্মসূচি চলাকালীন সৃষ্ট ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। অভিযোগ করা হয়, নাশকতার। এই মামলায় হাইকোর্ট তাদের আগাম জামিন প্রদান করলেও গতকাল নিম্নআদালতে আত্মসমর্পণের পর বিচারক শুনানি শেষে জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর আদেশ দেন।
কারাবন্দীদের মধ্যে আছেন, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাড.সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, সদস্য মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, সদর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, জেলা যুবদলের সভাপতি এম তমাল আহমেদ, জেলা কৃষক দলের সাবেক সহ-সভাপতি এস এম মোস্তাফিজুর রহমান কবির, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি রাজিদুর রহমান সাগর, সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান বাপ্পিসহ বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ। এ সময় বিচারক স্বাস্থ্যগত অবস্থা বিবেচনা করে ১২ জনকে জামিন প্রদান করেন। গতকাল সকাল থেকে আদালত প্রাঙ্গনে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের স্বজনের উৎকন্ঠিত পদচারণা লক্ষ্য করা যায়। অনেকে গভীর হতাশা প্রকাশ করে বলেন, স্পষ্ট মিথ্যা মামলা পুলিশ দায়ের করে সরকারি চাপে। কিন্তু আদালততো নিরপেক্ষ। আমরা ন্যায় বিচারের আশায় ছিলাম কিন্তু জামিন পেলাম না। জামিনবঞ্চিতদের স্বজনেরা বলেন, আমরা এখনও ন্যায় বিচার প্রাপ্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আদালত চত্বরে অনেক সাধারণ মানুষকে জামিন নামঞ্জুরের খবরে বিস্ময় প্রকাশ করতে দেখা যায়। আলাপকালে দলের একজন কর্মী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওই সময়টা মনে আছে না আপনার? ওই দিনতো সারা শহরে বিরোধীদলীয় কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় চলছিলো। সবাই আত্মগোপনে থেকে আন্দোলন করার পথ খুঁজছিলেন। অন্যদিকে সারা শহরে পুলিশ বিজিবির টহলের মাঝে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বোমা মেরে বেড়াচ্ছিল, তারা হামলা ভাঙচুর করছিল, বিএনপি নেতাদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। শহর যেন শ্মশান হয়ে গেছিলো। আমরাতো কেউ শহরেই ছিলাম না। অমিত ভাইকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছিলো। ওই কয়দিন ভাই অন্যদের মাধ্যমে খবর পাঠাতেন, আমরা যেন শান্তিপূর্ণ মিছিলটা করি। অথচ আজ তাঁকে ওই মিথ্যা মামলায় জেলে যেতে হলো!
এ প্রসঙ্গে অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের বড় ভাই শান্তুনু ইসলাম সুমিত রায় শুনে হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এটা দুঃখজনক যে, ঈদের আগে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পাওয়া ব্যক্তিকেও সাজানো মামলায় জেলে যেতেই হলো। এতো বিচার শুরুর আগেই শাস্তি ভোগের সামিল। তিনি বলেন, তবে এটা অবশ্য প্রথম নয়। গত ১৭ বছর ধরে এই অন্যায়, জুলুম চলছেই। তবে আমরা আইনি লড়াই চালিয়েই সবাইকে মুক্ত করবো ইনশা আল্লাহ।
ছেলের জামিনের জন্য আদালতে আসা নরেন্দ্রপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুলের ষাটোর্ধ্ব পিতা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার ছেলে ছাত্রদল করে এটাই তার বড় অপরাধ। আজকে পিতা হয়ে নিরীহ নিরপরাধ সন্তানের জন্য আদালতের বারন্দায়, এটা আমার জন্য খুবই কষ্টদায়ক। সামানে রোজার ঈদ। জানি না, আমার বড় খোকা ঈদের আগে বাড়ি ফিরবে কি না। আমি আশা করেছিলাম আদালত আমার খোকার জামিন দেবে। কারণ আমার খোকা কখনোই ওই ঘটনার সাথে জড়িত না। সদর উপজেলা শ্রমিক দলের যুগ্ম-সম্পাদক ওবাইদুল শেখ মুন্নার ২৩ বছর বয়সী বড় পুত্র ওমর ফারুখ শেখ হিমু বলেন, আমার পিতা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মাসহ আমার আরও তিনটি ভাই রয়েছে। পরিবারের অভিভাবককে কারাগারে রেখে আমরা কিভাবে ভালো থাকবো। সামনে ঈদ, বাবা যদি ঈদের আগে ছাড়া না পান, তাহলে ঈদের দিন ভালো খাবার পর্যন্ত আমাদের কপালে জুটবে না। বসুন্দিয়া ইউনিয়ন যুবদল নেতা ফিরোজ হোসেনের মা ফিরোজা বেগম ( ৬৫) একমাত্র ছেলের কারাগারে যাবার সংবাদ শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই প্রতিবেদকের সাথে মোবাইল ফোনে কথা হয় ফিরোজা বেগমের। ফিরোজের প্রসঙ্গে কথা উঠতেই তিনি আঁতকে ওঠেন। ফিরোজা বেগম জানতে চান, আমার ফিরোজ কখন বাড়ি আসবে। আমার নিরপরাধ ছেলেকে কেন কারাগারে পাঠানো হলো? তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ওর বাবা নেই, ফিরোজকে ছাড়া আমি বাড়িতে একা থাকতে পারবো না। ঈদ হবে কেমনে?
সদর উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক পলাশ খানের মা পঞ্চাশোর্ধ্ব ফাতেমা বেগম মোবাইল ফোনে বলেন, আমার ছেলে ছাত্রদল করে, এ ছাড়া তার কোনো অপরাধ নেই। আমি মা হয়ে জোর গলায় বলতে পারি আমার ছোট ছেলে পলাশ খুবই শান্ত স্বভাবের। সে কারও সাথে উচ্চস্বরে কথা পর্যন্ত বলে না। ষড়যন্ত্রমূলক আমার ছেলেকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। যে কারণে তাকে জেলখানায় যেতে হলো, সে কোনো দিন ওই ঘটনার সাথে জড়িত না।
বিএনপি কর্মী রেজাউল হাসানের স্ত্রী রেশমী আরা মুক্তা স্বামীর জামিন নামঞ্জুরের সংবাদ পেয়েই আদালত চত্বরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। হাজতখানার বাইরে এই প্রতিবেদকের সাথে তার কথা হয়। তিনি বলেন, বাড়িতে আমার ২০, ১৩ এবং ৪ বছর বয়সী তিন কন্যা সন্তান রয়েছে। বাড়িতে গিয়ে আমার সন্তানদের কিভাবে বলবো তোমাদের পিতা কারাগারে। মা হয়ে সন্তানদের সান্ত্বনা দেবার ভাষা নেই। আমার স্বামী নির্দোষ, ষড়যন্ত্রের শিকার। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ নেতা মীর মোশাররফ হোসেন বাবুর ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি। মানুষ ন্যায় বিচারের খোঁজে আদালতে আসে। কিন্তু সেখানে মানুষের কতটুকু ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয় সেটা আমার স্বামীর মাধ্যমে অনুধাবন করলাম।