চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত জজ আদালতের স্টেনোগ্রাফার আটক

0

চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতা॥ দুজন বিচারকের সই জাল করে নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্র ও নিয়োগপত্র তৈরি ও চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৫২ লাখ টাকা নেওয়ার অপরাধে চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বদলি হয়ে আসা স্টেনোগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটর আরাফাত জোয়ার্দ্দারকে পুলিশ আটক করেছে। আদালতের বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ সদর থানায় হওয়া মামলা ও লিখিত অভিযোগের বরাত দিয়ে জানান, চুয়াডাঙ্গা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের জনবল পূরণের জন্যে ২০২৩ সালের ২৮ মার্চ ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ভোরের কাগজ ও স্থানীয় দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়। ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ৪ জন নিম্নমান সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, একজন ড্রাইভার,একজন জারিকারক ও একজন অফিস সহায়কের জন্যে আগ্রহী প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র চাওয়া হয়। রাজবাড়ী জেলা সদরের মহাদেবপুর গ্রামের মান্নান জোয়ার্দ্দার ও সীমা বেগমের ছেলে স্টেনোগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটর আরাফাত জোয়ার্দ্দার রাজবাড়ী আদালত থেকে চুয়াডাঙ্গায় বদলি হয়ে আসেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তিনি চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে কৌশলে যোগাযোগ করেন। এরপর চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুয়াডাঙ্গা রেলপাড়ার ছাইদুর রহমানের ছেলে রেলস্টেশনের কাছের মাছের আড়ৎ হক ফিস সাপ্লাইয়ের স্বত্বাধিকারী নাহিদ হোসেনের কাছ থেকে ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর বেলা ১টার দিকে ওই আড়তে বসে ১৬ লাখ টাকা নেন। নাহিদ তার দু ভাগ্নে আরিফুল ইসলাম ও আছির উদ্দিনকে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন। ১৬ লাখ টাকা নেওয়ার সময় তিনি বলেন বাকি টাকা চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর দিতে হবে। এই টাকা গুণে নেওয়ার সময় নহিদ তা তার মোবাইল ফোনে ধারণ করেন। টাকা দেওয়ার মুহূর্তে পৌর এলাকার হাজরাহাটী উত্তরপাড়ার মরহুম জামাল উদ্দিনের ছেলে মাসুদুর রহমান ও সাদেক আলী মল্লিকপাড়ার মরহুম হামিদুল হকের ছেলে আমিরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া আরাফাত জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে জেলার জীবননগর উপজেলার ধোপাখালী গ্রামের ডালিমের ছেলে সাইফুল ইসলাম চুয়াডাঙ্গা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক এবং নিয়োগ ও পদোন্নতি সংক্রান্ত বাছাই কমিটির সভাপতি মাসুদ আলী বরাবর এক লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, সাইফুল ও মোক্তারপুর গ্রামের কামাল হোসেনের ছেলে তার ভাগ্নে মো. শারাফাৎকে আদালতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৪০ লাখ টাকার প্রস্তাব দেন। চাকরি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্যে দুজনকে আরাফাত জোয়ার্দ্দার ২০২৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রবেশপত্র দেন। তারা দুজন ওই দিন আদালতে বসেই পরীক্ষা দেন। পরীক্ষা দেওয়ার পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আরাফাত জোয়ার্দ্দার সাইফুল ইসলামকে নিম্নমান সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে এবং তার ভাগ্নে শারাফাৎকে অফিস সহায়ক পদে যোগদানের জন্যে নিয়োগপত্র দেন। কিন্তু সাইফুল ইসলামের নিয়োগপত্রে জেলা জজের কার্যালয়,চুয়াডাঙ্গার আদেশ নং-১৭ (এটি) ও তারিখ ১১.০৯.২০২৩ উল্লেখ করে এবং মো. শারাফাৎতের নিয়োগপত্রে জেলা জজ কার্যালয়,চুয়াডাঙ্গার আদেশ নং-১৯ (এটি) ও ২৭.০৮.২০২৩ তারিখ উল্লেখ করেন। সাইফুল ইসলামের নিয়োগপত্রে ১১.১০.২০২৩ তারিখ হতে ১৯.১০.২০২৩ তারিখের মধ্যে এবং শারাফাৎতের নিয়োগপত্রে ০৫.১০.২০২৩ তারিখ হতে ১১.১০.২০২৩ তারিখের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলা জজ আদালতে যোগদান করতে হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। ডাকযোগে এ নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পর ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বেলা আনুমানিক ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে আরাফাত জোয়ার্দ্দারকে ৩৬ লাখ টাকা নগদ পরিশোধ করা হয়। এ টাকা নেয়ার সময় আরাফাত জোয়ার্দ্দারের পিতা মান্নান জোয়ার্দ্দারসহ আরো অজ্ঞাত দু’ব্যক্তি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এ টাকা গুণে নেয়ার দৃশ্য মোবাইল ফোনে কৌশলে ধারন করে রাখা হয়। এ সময় জীবননগর উপজেলার মুক্তারপুর গ্রামের হায়দার আলীর ছেলে কামাল হোসেন ও একই উপজেলার খয়েরহুদা গ্রামের জাহাঙ্গীর আলীর ছেলে ইমরান আলী উপস্থিত ছিলেন। তিনি আরো জানান, ওই দু’জনকে নিয়োগপত্র দেয়ার কিছুদিন পর ডাকযোগে ওই নিয়োগ স্থগিত হয়েছে বলে তারা একটি পত্র পান। যাতে উল্লেখ করা হয় যে, হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নং-৮০৬৪/২০২৩ এর নির্দেশে নিয়োগ স্থগিত রাখা হলো। এরপর তারা ডাকযোগে আরো একটি পত্র পান। তাতে উল্লেখ ছিল ৮০৬৪/২০২৩ মামলাটি ০৮.১১.২০২৩ তারিখে খারিজ হয়েছে। সে কারণে গত ১৯.১১.২০২৩ তারিখে আরো একটি পত্র দিয়ে বলা হয় নিয়োগপ্রাপ্ত সকল প্রার্থীকে ০৮.০১.২০২৪ তারিখে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ওই তারিখে জেলা জজ আদালতে যোগদান করতে এসে তারা জানতে পারেন, চুয়াডাঙ্গা জজ আদালত থেকে কোন চাকরির নিয়োগপত্র দেয়া হয়নি। আরাফাত জোয়ার্দ্দার প্রতারণার মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক এবং জেলা জজ আদালতের নিয়োগ ও পদোন্নতি সংক্রান্ত বাছাই কমিটির সভাপতি মো. মাসুদ আলীর সই জাল করে নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্র এবং জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ মো. জিয়া হায়দারের সই জাল করে আর্থিক সুবিধার মাধ্যমে নিয়োগপত্র দিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ ঘটনার পর চুয়াডাঙ্গা শহরের রেলপাড়ার ছাইদুর রহমানের ছেলে নাহিদ হাসান বাদি হয়ে আরাফাত জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা করেন।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে নিয়োগ কমিটির সভাপতি বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন জেলার জীবননগর উপজেলার ধোপাখালী গ্রামের ডালিমের ছেলে সাইফুল ইসলাম। এরপর থেকে আরাফাত জোয়ার্দ্দার চুয়াডাঙ্গা জজ আদালতে তার কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। মামলার বিষয়টি চুয়াডাঙ্গা সদর থানা থেকে পাঠানো এক পত্রের মাধ্যমে জেলা ও দায়রা জজ অবহিত হন। তারপর অনুপস্থিতির কারণ দর্শানোর জন্যে ২০২৪ সালের ৯ জানুয়ারি একটি অফিস আদেশ আরাফাত জোয়ার্দ্দারের রাজবাড়ী জেলার স্থায়ী ঠিকানায় এবং ওই মাসের ১৪ জানুয়ারি তার প্রতারণার বিষয়ে জানতে আরেকটি অফিস আদেশ ডাকযোগে পাঠানো হয়। দুটি আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর তিনি ডাক বিভাগের প্রাপ্তি স্বীকার রশিদে সই করেন।