মনিরামপুরে আলোচনার শীর্ষে স্বপন ভট্টাচার্য্যরে পরাজয়

0

মজনুর রহমান,মনিরামপুর (যশোর)॥ সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-৫ মনিরামপুর আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যরে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএম ইয়াকুব আলীর কাছে পরাজয়বরণ নিয়ে এলাকায় চলছে আলোচনা- সমালোচনাসহ বিশ্লেষণ।
এ ব্যাপারে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য। তবে অধিকাংশ মানুষ তিনটি বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। সেগুলো হলো- নিয়োগসহ বিভিন্ন সেক্টরে ঘুষ বাণিজ্য ও দুর্নীতি, ছেলে-ভাগ্নের অপকর্মের সিন্ডিকেট এবং দলের ভেতর একক কর্তৃত্ব। দশম সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী খান টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ের মাধ্যমে স্বপন ভট্টাচার্য্যরে রাজনৈতিক উত্থান হয়। এবার নৌকার প্রার্থী হয়ে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলীর কাছে পরাজিত হয়ে তার রাজনৈতিক পতন হলো বলে মনে করেন মনিরামপুরের মানুষ।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, সারাজীবন আমি মনিরামপুরবাসীর ভাগ্যের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছি।
অনুসন্ধানে জানা যায়,বাংলাদেশের বৃহত্তম উপজেলা মনিরামপুরের ১৭টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে যশোর-৫ আসন গঠিত। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি স্বপন ভট্টাচার্য্য ২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সে সময় তিনি ছিলেন ক্লিন ইমেজের অধিকারী। ফলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে তার বেশি সময় লাগেনি। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন বীর মুক্তিযোদ্ধা খান টিপু সুলতান। অপরদিকে বিদ্রোহী হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন স্বপন ভট্টাচার্য্য। জনশ্রতি রয়েছে, বিরোধী দলের সাথে সমঝোতা করে স্বপন ভট্টাচার্য্য কলস প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আর এ জন্যে তাকে দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওই সময় তিনি দলের ভেতর প্রচন্ড কোনঠাসা হয়ে পড়েন। ২০১৭ সালে সাবেক সংসদ সদস্য খান টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর হাইকমান্ড স্বপন ভট্টাচার্য্যরে বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহার করে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করে। এ নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হন। ২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান, ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সমর্থ হন।
স্থানীয়রা মনে করেন, ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর পরই তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই মূলত তার জনপ্রিয়তায় ধস নামতে শুরু করে। উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে কালো টাকার পাহাড় গড়তে তিনি জড়িয়ে পড়েন স্বজনপ্রীতি, অনিয়মসহ নানাবিধ দুর্নীতিতে। নামে -বেনামে অঢেল সম্পত্তির মালিকও হন তিনি। এ ছাড়া দলের ভেতর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন, মামলাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানির মাধ্যমে কোনঠাসা করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব কারণে তিনি এ নির্বাচনে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন নি।
ঝাপা ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা শামছুল হক মন্টু বলেন, স্বপন ভট্টাচার্য্য উন্নয়নের নামে টিআর, কাবিখা, কাবিটা, এডিবিসহ বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অতিমাত্রা কমিশন এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন দপ্তরে বেপরোয়া নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের দশ শতাংশ কমিশন বাবদ সাড়ে তিন কোটি টাকার ঘুষ দাবি নিয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা(পিআইও) আব্দুল্লাহ বায়েজিদ এবং প্রতিমন্ত্রীর ছেলে সুপ্রিয় ভট্টাচার্য্য শুভর কথোপকথন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মিকাইল হোসেন বলেন, অনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্যে প্রতি ইউনিয়নে অযোগ্য ও সুযোগ সন্ধানী লোক পুষেছেন তিনি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক ফারুক হোসেন বলেন, দলের কর্তৃত্ব আয়ত্ব করতে তিনি(স্বপন ভট্টাচার্য্য) প্রকৃত ত্যাগী নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলায় আসামি করা ছাড়াও বিভিন্নভাবে হয়রানি করে সুবিধাবাদিদের নিয়ে দলের ভেতর নিজের বলয় সৃষ্টি করেছেন। এছাড়াও প্রতিমন্ত্রীপুত্র সুপ্রিয় ভট্টাচার্য্য শুভ এবং ভাগ্নে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান উত্তম চক্রবর্তী বাচ্চুর নেতৃত্বে প্রতিটি এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে অপকর্মের সিন্ডিকেট। আর এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্বসহ নানা অপকর্মের কারণে দলীয় কর্মীসমর্থক ছাড়াও সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে তার দিক থেকে এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। যে কারণে নির্বাচনে স্বপন ভট্টাচার্য্য তার ভরাডুবি ঠেকাতে পারেন নি।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, সারাজীবন আমি মনিরামপুরবাসীর ভাগ্যের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছি।
পরজয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি সব সময় জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। জনগণ যেটা ভাল বুঝেছে সেটাই করেছে। জনগণের রায়কে আমি শ্রদ্ধা করি।
সংসদ সদস্য পদে জয়ী কৃষক লীগের নেতা এসএম ইয়াকুব আলীর ভাষ্য, মনিরামপুরের জনগণ অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের রায়েই তার জয় এসেছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএম ইয়াকুব আলীর কাছে ৫ হাজার ১৩৬ ভোটে হেরে গেছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য। আওয়ামী লীগের এ প্রার্থী নৌকায় পেয়েছেন ৭২ হাজার ৩৩২ ভোট। বিপরীতে ঈগল প্রতীকে ৭৭ হাজার ৪৬৮ ভোট পেয়েছেন জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি ইয়াকুব আলী।