দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আজ *এবারের নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না: সিইসি *বাংলাদেশে নির্বাচন ঘিরে দমনমূলক পরিবেশ নিয়ে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞের ক্ষোভ

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ আজ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের প্রধান বিরোধী দলের বর্জন ও দেশে বিদেশে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ নির্বাচন। গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী আব্দুল আউয়াল বলেছেন, এবারের নির্বাচনে কাক্সিক্ষত মাত্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। অপরদিকে বাংলাদেশে নির্বাচনকে ঘিরে দমনমূলক পরিবেশ নিয়ে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ জাতিসংঘের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা ও সমিতি গঠনের অধিকারবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ক্লেমেন্ট এন ভৌল। এমনকি নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে বিরোধীদল কারা হবে তা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আজ ২৯৯ আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নওগাঁ-২ আসনে একজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় ওই আসনের ভোট বাতিল করেছে ইসি। যদিও শুক্রবার রাতে গাইবান্ধা-৫ আসনে ইসি ভোট বন্ধ ঘোষণা করেছে বলে গুঞ্জন ওঠে। পরে নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানান।
দ্বাদশ নির্বাচনে ২৯৯ আসনে এক হাজার ৯৭০ প্রার্থী নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে লড়াই করছেন এক হাজার ৫৩৪ প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন ৪৩৬ জন।
গতকাল শনিবার দুপুরে দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ইসি।
আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট হবে দাবি করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রার্থীকে ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট রাখার অনুরোধ করছি। যেন ভোটাররা ভোটদানে বাধাগ্রস্ত না হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। আমরা চাই আমাদের নির্বাচন কেবল দেশীয়ভাবেই না, আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়।’
ইসির প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় দেখা গেছে, এবার সারা দেশে ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ। মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৭৬ লাখ ও নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ। আর ট্রান্সজেন্ডার ভোটার ৮৪৯ জন। এর মধ্যে ১ কোটি ৫৪ লাখ নতুন ভোটার। যারা প্রথমবার ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন।
এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী রয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। হাইকোর্ট থেকে তিনজন প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় দলটির প্রার্থী ২৬৬ জন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির ২৬৫ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছিল। তবে তাদের মধ্যে অনেকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। দলটির একটি সূত্র জানিয়েছে, এখনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৮০ প্রার্থী। তবে নির্বাচনী মাঠে আছেন শ খানের প্রার্থী।
এদিকে তৃণমূল বিএনপির ১৩৫, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯৬, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ৫৬ জনসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী সংখ্যা এক হাজার ৫৩৪ জন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৬ জন। সব মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৯৭০ জন। এর মধ্যে ৯০ জন নারী ও ৭৯ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপিসহ ১৬টি দল এ নির্বাচন বয়কট করেছে। নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একাধিক দাবিতে নির্বাচন থেকে দূরে রয়েছে দলগুলো। বিএনপি ভোটে অংশগ্রহণ না করা নিয়ে সিইসি গতকালের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে এটি আরো গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হতো। তারা ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। আমরা বলব, ভোটারদের ভোট দিতে আসা উচিত।’
এদিকে এবারের নির্বাচনে কাক্সিক্ষত মাত্রায় অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতির মধ্যে জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি এই কথা জানান। সন্ধ্যা ৭টায় তার এই ভাষণ রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়।
সিইসি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে কার্যকরভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে নির্বাচন অধিক পরিশুদ্ধ ও অর্থবহ হয়। তাতে জনমতেরও শুদ্ধতর প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে সংহত ও টেকসই হয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন হয়। কিন্তু নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিগত প্রশ্নে মতবিরোধের কারণে এবারের নির্বাচনে কাক্সিক্ষত সেরকম রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। নির্বাচনী সার্বজনীনতা প্রত্যাশিত মাত্রায় হয়নি। তারপরও ২৮টি দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করছে।
নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করে বলেন, ‘ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বকে উপেক্ষা করে তথাকথিত এই ভোট রঙ্গ দেশকে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে নিয়ে যাচ্ছে।’
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ভার্চুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
রিজভী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে আগামীকাল ৭ জানুয়ারি আরও একটি একতরফা পাতানো নির্বাচনের সবচেয়ে অন্ধকারময়-তিমিরাচ্ছন্ন অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে। আজ এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রিয় মাতৃভূমি। দেশ এক গভীর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে তামাশার ভোটের একদিন আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোববারের ভোটের ব্যালট পেপারে নৌকায় সিল মারা ছবি দিয়ে পোস্ট করছে আওয়ামী লীগের লোকজন। এসব ছবি প্রমাণ করে কী ধরনের নির্বাচনী তামাশা মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে।’
অপরদিকে বাংলাদেশে নির্বাচনকে ঘিরে দমনমূলক পরিবেশ নিয়ে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ জাতিসংঘের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা ও সমিতি গঠনের অধিকারবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ক্লেমেন্ট এন ভৌল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে তিনি একথা প্রকাশ করেছেন।
শুক্রবার (০৫ জানুয়ারি) নিজের অফিসিয়াল এক্স (আগের টুইটার) একাউন্ট থেকে ক্লেমেন্ট এন ভৌল লিখেছেনঃ
বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মী এবং সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন বন্ধ করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আমাদের একাধিক আহ্বান সত্ত্বেও আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে দমনমূলক পরিবেশ নিয়ে আমি গভীরভাবে ক্ষুব্ধ।
ভিন্নমতকে নীরব করার জন্য সুশীল সমাজ সংগঠন, বিক্ষোভকারী ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে অতিরিক্ত ব্যবহার, সহিংসতা এবং অপরাধীকরণ থেকে বিরত থাকার জন্য আমার আগের আহ্বানগুলো পুনর্ব্যক্ত করছি।
নির্বাচনের আগে, নির্বাচন চলাকালীন এবং নির্বাচনের পর শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সমিতির অধিকার এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রয়েছে কর্তৃপক্ষের।
ইন্ডিপেন্ডেন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে একটিমাত্র ফলাফল হতে পারে জেনেও নির্বাচনে বাংলাদেশ।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- ‘রোববার বাংলাদেশে ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু এর ফল কি হবে তা এরই মধ্যে জানা। সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিধর নারী শেখ হাসিনা পঞ্চম মেয়াদে সুনির্দিষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন। একে সমালোচকরা ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রোববারের এই ভোট বর্জন করছে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। তাদের যুক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের অধীনে নির্বাচন হবে নিরর্থক ও ত্রুটিপূর্ণ।
এ বছর বিশ্বে অনেক দেশে নির্বাচন হবে। তার মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম। এটা এমন এক সময়ে ঘটছে যখন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের মানদ-ের অবনতি হচ্ছে। এ বছর বিশ্বে ভোট দেবেন প্রায় ২০০ কোটি বৈধ ভোটার। একসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে আওয়ামী লীগ।
এই দলটির নেতৃত্বে আছেন এখন ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা। খেয়ালখুশিমতো আটকের মাধ্যমে ভিন্ন মতাবলম্বীদের কণ্ঠকে রোধ করার মাধ্যমে তিনি দেশকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযুক্ত হচ্ছেন। বিরোধীদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন ও দেশের ভিতরে আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্য এর কড়া নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবেন যেসব কর্মকর্তা তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আগেই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।’
এমনকি নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে বিরোধীদল কারা হবে তা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন করা হয়েছে। দেশি- বিদেশি এ উদ্বেগ উপেক্ষা করেই আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেছেন, বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক যে নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আশা করছিলো সেটি শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে, কারণ নিবন্ধিত সব দল নির্বাচনে আসেনি।
অপরদিকে পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, নির্বাচন সহিংসতা মুক্ত রাখতে তারা সবরকম প্রস্তুতি নিয়েছেন। নাশকতার কোনো সুযোগ দেয়া হবে না।