যশোরে বিশ্ববিদ্যালয় ও তরিকুল ইসলাম

0

হারুন জামিল ।। দিন তারিখটা এখন আর মনে নেই। তবে মনে আছে ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর। আমরা যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি এলাকায় একটি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হই। যশোর সদরের পশ্চিমাঞ্চলে মেয়েদের জন্য আলাদা কোন স্কুল নেই। এলাকার লোকজন আবদুলপুরে এক খন্ড জমি ক্রয় করে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। তারা আমাকে বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলামের সাথে কথা বলতে বলেন। আমি ঢাকায় মিন্টু রোডের বাসভবনে গিয়ে তরিকুল ভাইকে বিষয়টি জানাই। সবকিছু শুনেই কিছুটা ভ্রুকুঞ্চিতভাবে তিনি বললেন, নতুন করে এলাকায় কোন স্কুল প্রতিষ্ঠার দরকার নেই। ওই এলাকায় স্কুল কলেজ মাদরাসা যথেষ্ট আছে। ওগুলোর মান উন্নয়ন করতে হবে। তাছাড়া নতুন স্কুল কলেজ করতে গেলে এগুলো নিয়ে নানান রকম মন্দ অভিজ্ঞতা হয়। মানুষ বাজে মন্তব্য করে। তোমার এসব নিয়ে এতো ভাবনার দরকার নেই। যা করছো- সেদিকেই মনযোগী হও। আমি ঘাবড়ে গেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বেজার মুখে খানিক বসে থেকে বললাম,একটা ভাল কাজে মন দিতে চাইলাম। আপনি না করলেন। এতে তো আপনার কোন টাকা পয়সা খরচ হছ না। এলাকার ছেলেরা সব করবে। ওরা জমির বায়না দিয়েছে। এখন আপনাকে বলার জন্য আমাকে জানিয়েছে। আপনি না করে দিলেন! অভিমানে গম্ভীর হয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকলাম। ভাই আমার মতিগতি বুঝতেন। বিষন্ন মলিন বদনে বের হয়ে আসার সময় বললাম, আমি আর আপনার কাছে আসবো না। বাসায় চলে গেলাম। তিনদিন আমি আর মিন্টু রোডে যাইনি। চতুর্থদিন সন্ধ্যার পর তথ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা শামসুর রহমান আমার অফিসে হাজির। বললেন,স্যার ডেকেছেন। এক্ষণি আমার সাথে যেতে বলেছেন। আমি তার সাথে মিন্টু রোডে হাজির হলাম। ভেতরে ঢুকতেই বসতে বলে একচোট বকাবকি করলেন। বললেন,আমি চাইনে ¯’ানীয় কোন ভিলেজ পলিটিক্সে তুমি শামিল হও। অনেকক্ষণ বুঝালেন। এসব প্রতিষ্ঠান করতে গিয়ে ভালমন্দ নানাবিধ অভিজ্ঞতার কথা বললেন। আর বললেন, তুমি সরল মানুষ। এলাকার প্রতি দেশের প্রতি তোমার মমত্ববোধ আছে। সুবিধাবাদী শ্রেণীর লোকেরা তোমার এ সরলতার সুযোগ নিতে চাইবে। তারা জানে কোথায় কথা বললে কাজ হবে। তুমি এসব বোঝোনা। ওসব নিয়ে ব্যবসা করবে অন্যলোক। বদনাম হবে তোমার। বদনাম করবে আমার। আমি চুপচাপ সবকিছু শুনলাম। এর সপ্তাহ দুয়েক পরই ভাই আমাকে মোবাইল থেকে কল দিয়ে ডেকে নিলেন। সন্ধ্যায় মিন্টু রোডে হাজির হলাম। সামনে বসে আছি। তিনি বললেন, যশোরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির প্রতিনিধি দল স্থান নির্ধারণের জন্য পরিদর্শনে যাবেন। বেশ কয়েক জায়গা তারা পরিদর্শন করবেন। যশোর বেনাপোল রোড,ভাতুড়িয়া বিল, নড়াইল রোড,বাহাদুরপুর মাঠ আর চুড়ামনকাটিতে তোদের এলাকায় যাবেন। তুই দেলোয়ার হোসেন খোকনের (জেলা বিএনপির নেতা) সাথে কথা বলে বিস্তারিত জেনে নে। আর বললেন, জেলা প্রশাসক ওয়াজেদ আলীর সাথে কথা বল। আমি তাত্বিকভাবে কোথায় হলে ভাল হয়, কোথায় হলে কি সমস্যা তানিয়ে কথা বলতেই আবার খানিক ধমকালেন। বললেন, যা বলছি তাই কর। রাতেই জেলা প্রশাসক আর খোকন ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। বিস্তারিত শুনে যশোর গেলাম। এরপর উ”চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলটি সরেজমিন পরিদর্শন শেষে রিপোর্ট দিলেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হিসাবে যশোর-চৌগাছা রোডের আমবটতলাই উপযুক্ত স্থান। ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবার আগেই শ্যামনগরের আফতাব উদ্দিন এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। পুরো প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। খবরটি শুনে আমি ভাইকে জানালাম। তিনি খুবই দুঃখ পেলেন। হাইকোর্টে এই রিট আবেদন শুনানী করে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আমাকে একাধিকবার তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলীর কাছে পাঠান। এজে মোহাম্মদ আলী ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে রিট আবেদনটি শুনানী করেন। আমাকে বলেন, লেগে থাক। লেগে না থাকলে এটা হবেনা। আমবটতলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিলে যশোরের একাধিক জায়গা থেকে তদবির শুরু হয়। তরিকুল ভাই তখন বলেন, শহরের উত্তর-পূর্ব কিংবা দক্ষিণ এলাকা অনেক উন্নত হয়েছে। শহর বেড়েছে এইসব এলাকায়। কিন্তু পশ্চিম এলাকা অনেকটা পিছিয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি সেখানে হলে সবার সুবিধা হবে। এছাড়া উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে চুড়ামনকাটি এলাকা এগিয়ে যাওয়ায় তিনি মনে করতেন, প্রতিষ্ঠানটি সেখানেই ভাল হবে। শিক্ষিত মানুষেরা প্রতিষ্ঠানটির কদর বুঝবে। ভাই প্রায়ই একটি কথা বলতেন, “বাড়িতে পান্তা ভাত খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। আমাদের সময়ে আমরা এ সুবিধা পাইনি।”
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলামের সাথে কথা বলে এটিকে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক যশোরের আরেক কৃতি সন্তান নাসিমুল গণিকেও এদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য বিশেষভাবে বলেন। এ দুজনের সার্বক্ষণিক তদারকি ও প্রচেষ্টায় প্রকল্পটি গতি পায়। প্রথম প্রকল্প পরিচালক হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসর বিজ্ঞানী প্রকৌশলী ড. রফিকুল ইসলাম সরকার। ড. রফিকুল ইসলাম সরকার একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাবিদ। দিনরাত তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এই প্রতিষ্ঠানের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরাসরি তদারকির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক মুজিবুর রহমানকে যশোরের জেলা প্রশাসক হিসাবে নিয়ে যান তিনি। এরপরের জেলা প্রশাসক আবুয়াল হোসেনও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অনেক ঘাম ঝরা পরিশ্রমের পর ২০০৬ সালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। হাটি হাটি পা পা করে বৃহত্তর যশোরবাসীর গর্ব করার মত প্রতিষ্ঠান হিসাবে এগিয়ে যাচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর কলেবর বেড়েছে। গতিময়তা পাঠদান গবেষণা সবই এগিয়ে চলেছে। কিন্তু যিনি এই স্বপ্নপূরণের সারথী হয়ে আছেন কেন যেন তিনি ক্রমেই অলক্ষ্যে হারিয়ে যাচ্ছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আমবটতলায় অসুস্থ’ শরীর নিয়ে বহুবার গেছেন। জনসম্মুখে যেসব কথা বলেছেন তার সাক্ষী হয়ে আছেন প্রজন্মের অসংখ্য মানুষ।
তরিকুল ইসলাম জাতীয় নেতা ছিলেন। বিএনপির নীতি নির্ধারকদের একজন ছিলেন। কিন্তু মনেপ্রাণে যশোরের মানুষের জন্য তার ভালবাসা ও দরদ ছিল অপরিসীম। তার দেশপ্রেমবোধ ছিল প্রখর। যশোরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল তার আজীবন লালিত স্বপ্ন। তিনি রাজনীতি করতেন। মন্ত্রী ছিলেন একাধিকবার। কিন্তু একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই যে দেশকে এগিয়ে নিতে পারে,নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত মানুষই পারে নেতৃত্ব দিতে সেকথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যশোরবাসীর অবদান অনেক। কিন্তু স্বপ্নপূরণের জন্য নেতৃত্ব দিয়ে তিনি আজীবন মানুষের শ্রদ্ধা কুড়াবেন। তার ভালবাসার এ ঋণ কোনদিন শোধ হবেনা।