অটোপাস-আন্দোলন-নীতিমালা প্রণয়নে বছর পার শিক্ষাঙ্গনে

0

মুরাদ হুসাইন॥ টানা দেড় বছর পর সীমিত আকারে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে এনে পাঠদান শুরু হয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে অটোপাস। এছাড়া সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের পদোন্নতি, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি, স্কুল ভর্তির ডিজিটাল লটারি কার্যক্রম চালু ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। এছাড়া এ বছরই হয়েছে বেশ কয়েকটি নীতিমালা প্রণয়ন। পাশাপাশি ছিল চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষক আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক ও হাফ ভাড়ার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। চলমান মহামারিতে অনেক সম্ভাবনা তৈরি হলেও কাজে লাগানো যায়নি তার সবটুকু। এভাবেই কেটেছে মহামারিতে বিপর্যস্ত শিক্ষাখাতের আরও একটি বছর।


অটোপাস: করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনুষ্ঠিত হয়নি এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এ কারণে বছরের শুরুতেই (৩০ জানুয়ারি) প্রকাশ করা হয় ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অটোপাসের ফল। জেএসসির ২৫ শতাংশ ও এসএসসির ৭৫ শতাংশ ফলের ভিত্তিতে এবার এইচএসসি অটোপাসের ফল প্রকাশ করা হয়। এতে পাস করেছে শতভাগ শিক্ষার্থী । জিপিএ-৫ পেয়েছে আগের বছরের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি।
সংক্ষিপ্ত আকারে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা: করোনা পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট সময়ের ৮ মাস পর ১৪ নভেম্বর শুরু হয় এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা। এতে অংশ নেয় ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন শিক্ষার্থী। এরপর ২ ডিসেম্বর শুরু হয় এইচএসসি পরীক্ষা। এ পরীক্ষা চলবে চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সারাদেশে এসএসসিতে ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬৯০ জন অংশ নিচ্ছে।


শিক্ষার্থীদের আন্দোলন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা, হল খোলা, পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকির প্রতিবাদ, গণপরিবহনে হাফ ভাড়া চালু, গাড়িচাপায় শিক্ষার্থী হত্যার বিচারসহ নানা দাবিতে সড়কে সরব ছিল শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছভর্তি পরীক্ষা: দেশের ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে প্রথমবারের মতো ২০২০-২১ সেশনের স্নাতক প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ পরীক্ষার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ছিল অভিযোগ।


পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন: চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে আয়োজন করতে আইন সংশোধন করা হয়। এর আলোকে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর সঙ্গে নবম ও দশম শ্রেণির কারিকুলাম অনুযায়ী সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৩ সাল থেকে পরিমার্জিত কারিকুলামে শুধু দশম শ্রেণির কারিকুলামেই এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যের মতো বিভাজন থাকবে না। এক্ষেত্রে সমন্বিত শিক্ষাক্রম হবে। পুরো শিক্ষাক্রম ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে।
নানা দাবিতে শিক্ষকরাও মাঠে: বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ, ইবতেদায়ি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ২৫ শতাংশের পরিবর্তে পূর্ণাঙ্গ ঈদ বোনাস, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবি, বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধানদের পদ গ্রেড-৬ করাসহ নানা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।

এপিএ মূল্যায়নে দ্বিতীয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ: ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) মূল্যায়নে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা পুরস্কার অর্জন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ।
ডিজিটাল লটারি সিস্টেমে ভর্তি: মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত তদবির, ভর্তি বাণিজ্য বন্ধ করতে ডিজিটাল লটারি প্রক্রিয়ায় এসেছে সরকার। গত বছর কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি লটারি আয়োজন করা হলেও এবার সারাদেশের প্রায় ৩ হাজার বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তিতে কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিটাল লটারি আয়োজন করা হয়।
‘শিক্ষা আইন’ খসড়ায়ই: পাঁচ বছর ধরে শিক্ষা আইন প্রণয়নের কাজ ঝুলে রয়েছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে কওমি মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের জন্য সব ধরনের নোট ও গাইডবই নিষিদ্ধের বিধান রেখে চলতি বছর ‘শিক্ষা আইন-২০২১র খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
শিক্ষক পদোন্নতি: দীর্ঘ অপেক্ষার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো ৫ হাজার ৪৫২ জন সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারের ১ হাজার ৮৪ জন সহকারী অধ্যাপককে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যদিও পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নিয়ে বির্তক রয়েছে।
প্রভাষকদের পদোন্নতি- মূল্যায়ন: বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের পদোন্নতিতে মূল্যায়নের মাধ্যমে দেওয়া হবে। এই মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রভাষকদের পদোন্নতির ১০০ নম্বরের মূল্যায়ন পরীক্ষা থাকবে। এর মধ্যে ১০ নম্বর অনলাইন ক্লাসের দক্ষতার ওপর রাখা হয়েছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক নিয়োগে বৃহৎ গণবিজ্ঞপ্তি: দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে মোট ৫৪ হাজার ৩০৪ জন শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ৩১ হাজার ১০১ জন, মাদরাসা, কারিগরি ও ব্যবসায়ী ব্যবস্থাপনায় ২০ হাজার ৯৯৬ ও সংরক্ষিত আসনে ২ হাজার ২০৭ জন। বর্তমানে এ নিয়োগের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চলমান।
এমপিও নীতিমালা-২০২১ জারি: বেসরকারি স্কুল-কলেজের সংশোধিত এমপিও নীতিমালা-২০২১ ও জনবল কাঠামো জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রায় দেড় বছর সংযোজন বিয়োজনের পর নীতিমালাটি জারি করা হয়। সংশোধিত এমপিও নীতিমালা অনুসারে ১১তম গ্রেডে বেতন পাবেন ইবতেদায়ির প্রধান শিক্ষকরা।
ব্লেন্ডেড লার্নিং নীতিমালা: উচ্চশিক্ষায় সশরীরে ও অনলাইন শিক্ষা সমন্বিত করে ব্লেন্ডেড লার্নিং নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম ওয়াহেদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, করোনার মধ্যে আমাদের অনেক সম্ভাবনা তৈরি হলেও তার অনেকটা কাজে লাগাতে পারিনি। শুধু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ওপর নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভার রয়েছে। একদিকে শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা থাকবে না অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষা স্থায়ীভাবে নিতে আইন প্রণয়ন করছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সদ্য সাবেক সচিব মো. মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, করোনার শুরুতে আমরা অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ি। অনেক চেষ্টার ফলে শিক্ষাব্যবস্থাকে বড় সংকটের হাত থেকে রক্ষা করা গেছে। এর মাধ্যমে আমাদের অনেক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেটি কাজে লাগাতে পারলে যে কোনো ধরনের সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তার অনেকটাই সফলতা এসেছে। আমাদের কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে বলে অনেক কিছু করার থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। করোনার কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে বলেও জানান তিনি।