সেই বজ্র হুংকার “আমি তরিকুল ইসলাম বলছি”

0

 

আসিফ কাজল ।। ১৯৮৯ সাল। স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের দাবানল স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। চারিদিকে গুমোট ভাব। প্রশাসন ব্যস্ত এরশাদের গদি বাঁচাতে। আমি তখন কোটচাঁদপুর সরকারী খোন্দকার মোশররফ হোসেন ডিগ্রি কলেজের ছাত্র। ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় বাড়ি হলেও স্কুল জীবনের বন্ধু ও ভাতিজা আনিচের পীড়াপীড়িতে ভর্তি হলাম কোটচাঁদপুর সরকারী কলেজে। গ্রামে গ্রামে চরমপন্থিদের ভয়াবহ নৃশংসতার মধ্যে চলছে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। শহরের আন্দোলন দমাতে পুলিশ ব্যস্ত। সেই সুযোগে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ও সর্বহারা পার্টির পাল্টাপাল্টি হত্যা আর রক্তের হোলি খেলায় ঝিনাইদহ পরিণত হয়েছে রক্তাক্ত জনপদে। ‘ডাঙ্গায় বাঘ আরে পানিতে কুমির’ এই পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতির হাতে খড়ি হলো আমার। খেলাধুলায় দক্ষ হওয়ার কারণে রাজনীতি করা সহজ হয়ে গেলো আমার জন্য। কোটচাঁদপুর কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ফুটবল খেলায় মনোনিবেশ করলাম। কোটচাঁদপুরের আশেপাশে যত ফুটবল মাঠ আছে সব মাঠেই আমি ফুটবল খেলেছি। খেলার মাঠের নৈপুন্য রাজনীতির মাঠে মেলে ধরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে সক্রিয় হয়ে উঠলাম। কোন পদপদবী না থাকলেও ফুটবলার হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার কারণে দলের মধ্যে অতি পরিচিত মুখ হিসেবে আর্বিভুত হলাম। কোটচাঁদপুরের নেতাদের কাছে তো বটেই জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হলাম আমার সাংগঠনিক কর্মদক্ষতা দিয়ে। স্বৈরাচার পতন আন্দোলন তখন নতুন বাঁকে। উত্তজনা আর শ^াসরুদ্ধকর পরিবেশ তখন প্রশাসনে। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য প্রতিনিয়ত মিছিল-মিটিং চালিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করে তুলেছে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৯০ সালের ফেব্রয়ারি মাসে ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারি কেএমএইচ কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ শামসুল ইসলামের সঙ্গে বাদানুবাদ হলো। তিনি ছাত্রদের নামে মামলা করলেন ভাঙচুরের। অধ্যক্ষ স্যারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার কমতি ছিল না। জেলা প্রশাসকের ইন্ধনে আসামি করা হলো ছাত্রনেতা আব্দুস সুবর খান, কবির হোসেন, হায়দার আলী, আব্দুল আলীম, লালন, কামাল হোসেন, শাওকত আলী, বকুলসহ ২৮ জন ছাত্রনেতাকে। মামলার পর কোটচাঁদপুরের তৎকালীন ওসি সিরাজুল ইসলাম আসামি ধরতে ভয়ংকর হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ইসলামী ছাত্র শিবির, জাসদ ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাদের টার্গেট করে গণগ্রেফতারের ছক কষা হয়। কোটচাঁদপুরের প্রগতি, শেরেবাংলা ও বলুহর বাসস্ট্যান্ডের টিটো ছাত্রাবাসসহ নেতাদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে অতিষ্ঠ করে তোলে পুলিশ। ছাত্র আন্দোলনের গতি কমাতে চলে এরশাদশাহীর নির্যাতনের স্টিমরোলার। ছাত্রদলের নেতারা যখন পুলিশি অভিযানের মুখে খেই হারিয়ে নিরাপদ জায়গা খুজছিলেন, তখনই এলো খুশির খবর। কোটচাঁদপুর পুলিশের ভয়াবহ অত্যাচার আর নির্যাতনের খবর পৌছে যায় দক্ষিণাঞ্চলের মুকুটহীন স¤্রাট জননেতা তরিকুল ইসলামের কাছে। সম্ভবত সে সময়কার কোটচাঁদপুর বিএনপির কান্ডারী সিরাজুল ইসলাম মামা ল্যান্ড টেলিফোনে তরিকুল ইসলামকে অবগত করান। দেরি না করে জননেতা তরিকুল ইসলাম ফোন করেন তৎকালীন ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক আসাদুজ্জামান ভুইয়ার কাছে। টেলিফোনে জেলা প্রশাসককে তিনি গুরুগম্ভীর সুরে বলেছিলেন “আমি যশোর থেকে তরিকুল ইসলাম বলছি। এই টেলিফোন যদি এরশাদের কাছে করি, তবে তিনি আমাকে মন্ত্রী বানিয়ে হয়তো যশোরে পাঠাতেন। এই ফোনের পর যদি কোটচাঁদপুরের ছাত্রনেতাদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ তল্লাশি বন্ধ করা না হয় তবে থানা ঘেরাও করে আগুন জ¦ালিয়ে দিতে বাধ্য হবো” দক্ষিনাঞ্চলের লৌহ মানব খ্যাত জননেতা তরিকুল ইসলামের এই বজ্রহুংকারের পর পুলিশ অভিযান বন্ধ হয়ে গেল। ছাত্রনেতারা কিছুটা স্বাভাবিক হলেন। স্বস্তি ফিরে আসলো কোটচাঁদপুরে। সাবধানতা অবলম্বন করে আবারো এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়লেন ছাত্র নেতারা। ১৯৯০ সালের গোটা বছর জুড়ে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ২৭ নভেম্বর টিএসসি’র মোড়ে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএমএ’র অন্যতম নেতা ডাঃ শামসুল আলম খান মিলনকে। ডাঃ মিলনের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশের মতো কোটচাঁদপুরের তার ঢেউ আছড়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ছাত্র সমাজ। ডাঃ মিলনের মৃত্যুর প্রতিবাদে স্বৈরাচার সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত ডাক্তাররা ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ডাক্তারদের এ ঘোষণার পর আইনজীবীরাও স্বৈরাচারী সরকাররের পতন না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘটের ডাক দেন। রাত ৯টা থেকে সরকার জরুরি অবস্থা জারি করলে এর প্রতিবাদে সরকারবিরোধী ৩ জোট লাগাতার হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার পর থেকে একই সঙ্গে চলতে থাকে কারফিউ এবং লাগাতার হরতাল। ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদের পতন ঘটে। এরশাদ পতনের পর কোটচাঁদপুর কলেজ মাঠের সবুজ ঘাস তরতাজা হয়ে উঠলো। কলেজের নবীনবরণ ও প্যানেল পরিচিতি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে আসলেন দক্ষিন বঙ্গের মুকুটহীন সম্রাট তরিকুল ইসলাম। মঞ্চে আসন গ্রহনের পর সেদিন কোটচাঁদপুরের ছাত্র নেতারা তার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। প্রতি উত্তরে মমতা আর গভীর ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিলেন আমাদের। সেদিন স্টেজ থেকে একটি গান কানে ভেসে আসতে লাগলো “একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে। ফিরবে না সে তো আর কারো আকাশে”। (লেখক : আসিফ কাজল, দৈনিক লোকসমাজের স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ)