দ্য হিন্দুর রিপোর্ট ‘১৯৭১ সালের মতো আবারও ভারতের উচিত বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন করা’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খাকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দেয়া উচিত ভারতের। ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ বুধবার এ কথা বলেছেন। এসময় তিনি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি গত ২৮শে অক্টোবর আন্দোলনের সময় সহিংসতা ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউনের জন্য সরকারী সংস্থাগুলি ও আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করেছেন তিনি।
দ্য হিন্দুকে ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণকে সেইভাবে সমর্থন করা যেভাবে তারা ১৯৭১ সালে আমাদের সমর্থন করেছিল। আজ বাংলাদেশের জনগণ স্বচ্ছ নির্বাচনের অধিকার ছাড়াই বাস করছে। আমার দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি আশা করি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের মুখে ভারত চুপ করে থাকবে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা ভারতের পক্ষ থেকে এমন কোনো মন্তব্য দেখিনি যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে উৎসাহিত করতে পারে।
একটি সংক্ষিপ্ত সফরের জন্য ভারতে গিয়েছেন এই বিএনপি নেতা। সফরের অংশ হিসেবে তিনি আজমির শরীফে মাজার জিয়ারত করেছেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির একটি ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন। ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, তিনি তার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অল্প কয়েকজনের একজন যারা এখন পর্যন্ত কারাগারের বাইরে আছেন।
যদিও তিনিও দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এ কারণে ছয় মাস ধরে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

এই বিএনপি নেতা ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিগত বিএনপি সরকারের বিদ্যুৎ ও কৃষিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে দাবি জানিয়েছে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং ভারতকেও একই পথ অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সমর্থনে কথা বলেছে। আমরা এটাকে স্বাগত জানিয়েছি এবং আমরা আশা করছি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ভারতও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সমর্থনে কথা বলবে।
বিএনপি গত ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় ‘মহা সমাবেশের’ ডাক দিয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সমাবেশ এক পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে পরিণত হয়। এর ফলে একজন পুলিশ নিহত হন। এরপর বাংলাদেশ সরকার বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তারের জন্য দেশব্যাপী ধরপাকড় চালায়। এতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
মাহমুদ বলেন, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বয়স ৭০ বছরের বেশি এবং তারা বেশ কিছু স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন। তাদের জরুরি চিকিৎসা সহায়তার প্রয়োজন ছিল, যা আওয়ামী লীগ সরকার প্রত্যাখ্যান করছে। জেলে আর কোনো জায়গা ফাঁকা নেই। আমাদের দলের কর্মীরা ধান ও পাট ক্ষেতে লুকিয়ে আছে।
গত ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলেছে বিএনপি। তবে বিএনপির এমন দাবি শেখ হাসিনা এখনও পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন। এরই মধ্যে অন্তর্র্বতী সরকার হতে পারে এমন ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। তবে এই বিএনপি নেতা দাবি করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্র্বতী সরকার কাজ করবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন। সে সময় আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেও গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুযোগ দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন তা অস্বীকার করছেন।
ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, বিএনপি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল যারা ‘রাজনৈতিক ইসলাম’-এর বিরোধিতা করে। উলটো তিনি ইঙ্গিত দেন যে, হাসিনা সরকারই ইসলামপন্থীদের সঙ্গে নরম আচরণ করছে। তিনি বলেন, বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক দল। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক জোট যেভাবে হয় ঠিক সেভাবেই জামায়াতের সঙ্গে আমাদের জোট হয়েছিল। সেটা এখন অতীতে। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপরে প্রশ্ন তোলা উচিৎ। কেন তিনিজামায়াতকে নিষিদ্ধ করেননি তার কাছে সেই জবাব চাওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলেও অভিযোগ করেন এই বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, এই সরকার জ্বালানি খাতকে মুনাফার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে কয়লা সরবরাহে ব্যাপক বিঘœ ঘটেছে এবং জনগণ লোডশেডিং-এ ভুগছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী?
উত্তর: যে দেশ তার বিরোধী নেতাদের জেলে বন্দি করে, তার অবস্থা ভালো হতে পারে না। ২৮শে অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের পর ৭০-এর কোঠায় এবং নাজুক শারীরিক অবস্থায় থাকা বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জেলের মেঝেতে ঘুমাতে বাধ্য করা হচ্ছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর বীর উত্তম, সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রশ্ন: বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারাই সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছে।
উত্তর: আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং আমাদের নতুন কর্মসূচি শুরু করা। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো আমাদের বৈঠকে বাধা দেয় এবং সহিংসতা সৃষ্টি করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন ভিডিও রয়েছে যা দেখায় যে, সরকারি এজেন্সিগুলি সহিংসতায় লিপ্ত ছিল। তারা যুবক থেকে বৃদ্ধ সবাইকে গ্রেপ্তার করেছে। আমাদের কর্মীরা ধান-পাট ক্ষেতে লুকিয়ে আছে। আমরা কারাবন্দী নেতাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা বয়সে প্রবীণ এবং নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছে, বিরোধী দল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং তাদের সাথে ইসলামপন্থীদের সম্পর্ক রয়েছে।
উত্তর: আমরা সবাই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি। আমি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা। মেজর জিয়াই ১৯৭১ সালে রেডিওতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগ বছরের পর বছর ধরে আমাদের সম্পর্কে মিথ্যাচার করে আসছে। জামায়াতের সঙ্গে আমাদের শুধুমাত্র নির্বাচনী জোট ছিল। গণতন্ত্রে নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক জোট তৈরি হয়। ভারতেও বিভিন্ন সময়ে বিজেপি ও বাম দলগুলোর মধ্যে অনেক জোট হয়েছে। বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক দল, কিন্তু আমরা রাজনৈতিক ইসলামে বিশ্বাস করি না। জামায়াতের সঙ্গে সেই জোট এখন অতীতের কথা। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জবাব দিতে হবে যে, তিনি ক্ষমতায় থাকা বছরগুলোতে কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেননি।
প্রশ্ন: শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচনের ডাক দিলে বিএনপি কি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে?
উত্তর: আমরা তার অধীনে নির্বাচনে যেতে পারি না। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল জালিয়াতির নির্বাচন। তিনি যদি তার বিজয়ের বিষয়ে এতই আত্মবিশ্বাসী হন তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন না কেন? তিনিই ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিলেন। সেই সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাস করার কারণে সেই দাবিতে সম্মত হন। সেই নির্বাচনে তিনি হেরে যান এবং শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। আমরা মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান করতাম।
প্রশ্ন: তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে, অন্তর্বর্তী সরকারে কি বিএনপি রাজি হবে?
উত্তর: শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্র্বতী সরকার আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেবেন না। মনে রাখবেন, বিগত দুটি নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এভাবে আরও একটি নির্বাচন হলে আমার দেশে গণতন্ত্র থাকবে না।
প্রশ্ন: আপনি এমন সময়ে ভারতে এসেছেন যখন বাংলাদেশ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে থাকার সময় আপনি কি ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে দেখা করেছেন?
উত্তর: আমার দাদার কবর কলকাতায় হওয়ায় ভারতের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। সেই কবরে শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের প্রতি বছর ভারত আসতে হয়। আমি বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক পরিবারের একজন যারা বৃটিশ আমল থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এইবার আমি আজমীর শরীফ পরিদর্শন করতে এসেছি এবং রাজনীতি সম্পর্কিত কোনো বৈঠক করিনি।
প্রশ্ন: ভারত বলেছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের রাজনীতির অংশ নয় কারণ বাংলাদেশের সংবিধানে এটি নেই।
উত্তর: সংবিধান কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ নয়। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯৬ সালে যেভাবে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনেছিলেন, ঠিক সেভাবেই এটি সংশোধন করা যেতে পারে। এখন জনগণ একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় এবং তাই জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য একই ধরনের সংশোধনী করা যেতে পারে। ভারতের উচিত ১৯৭১ সালে তারা যেভাবে বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন করেছিল সেভাবেই আবারও সমর্থন করা। আজ বাংলাদেশের জনগণ তাদের স্বচ্ছ নির্বাচনের অধিকার ছাড়াই বাস করছে। আমার দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি আশা করি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের মুখে ভারত চুপ থাকবে না। এখন পর্যন্ত আমরা ভারতের পক্ষ থেকে এমন কোনো মন্তব্য দেখিনি যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
[ সৌজন্যে মানবজমিন]