মোংলায় বেপরোয়া কাঁচামাল সিন্ডিকেট

0

মনিরুল হায়দার ইকবাল, মোংলা (বাগেরহাট)॥ পাইকারি কাঁচামাল বিক্রেতা সিন্ডিকেটের বেপরোয়া দৌরাত্ম্যে মোংলার সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে রয়েছে। সিন্ডিকেটের লাগামহীন মুনাফার কারণে আশপাশের বাজারের চেয়ে কয়েকগুণ চড়া দামে সাধারণ মানুষকে কিনতে হচ্ছে কাঁচা তরিতরকারি। অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, বাজার মনিটরিং কমিটি আর স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দিনের পর দিন কাঁচামাল সিন্ডিকেটের অবৈধ কারবার চললেও এদের বিরুদ্ধে কার্যকরী তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, মোংলা কাঁচা বাজারকে ঘিরে রয়েছে ৮/১০জনের সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটটি খুলনা, যশোরের সাতমাইল, আঠারোমাইল, কেশবপুর, সাতক্ষীরার তালা, শাহাদাতপুরসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারি পণ্য কিনে আনে। এরপর ওই সকল জায়গা থেকে যে দামে পণ্য কেনেন তার চেয়ে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি লিখিয়ে মোংলায় তাদের আড়তে আনেন। পরে সিন্ডিকেট আড়তে এনে তার ওপর আবার নতুন করে কেজিতে কয়েক টাকা বাড়িয়ে খুচরো বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে থাকে। আর বিক্রেতারা সিন্ডিকেট চক্রের আড়ৎ থেকে যে দামে পণ্য কেনেন তারাও কেজিতে ক্ষেত্র বিশেষ ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। সিন্ডিকেটটি বিভিন্ন এলাকা থেকে যে পণ্য আনে তা বাজারে একদিনে না ঢুকিয়ে গ্যাপ দিয়ে দিয়ে বিলম্বে ঢুকিয়ে বাজারে কাঁচামালের সংকট তৈরি করে রাখে। আর এ সংকট দেখিয়ে সিন্ডিকেটটি তাদের অর্থ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সিন্ডিকেট খুচরো বাজারে কোন পণ্য কত টাকায় বিক্রি করা হবে তা নির্ধারন করে দেয়। বেঁধে দেয়া দামের কমে কেউ বিক্রি করলে তাকে নানা ধরনের হয়রানি ও হুমকি প্রদান করা হয়।
এছাড়া সিন্ডিকেট বাজারে গ্রামের চাষিরা আসলে তাদেরকে প্রতিনিয়ত বসতে দেয় না। সপ্তাহে সোম, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শুক্রবার- এ ৪ দিন গ্রামের লোকদের তরকারি বিক্রি করতে দেয়া হলেও অন্য তিনদিন তাদের সবজি বিক্রি করতে দেয়া হয় না। কারণ গ্রামের লোকেরা কিছুটা কম দামে সবজি বিক্রি করে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, গ্রামের লোকেরা বাজারে মালামাল নিয়ে আসলে সিন্ডিকেট মালামাল কেড়ে নিয়ে ইচ্ছামত কোন রকম দাম দিয়ে তাদেরকে বিদায় করে দেয়। এ ছাড়া সিন্ডিকেটের নির্ধারিত দামের কমে কেউ বিক্রি করলে তাকে হয়রানি করাসহ নানা ধরনের হুমকি ও চাপ প্রদান করা হয়ে থাকে।
শুক্রবার সকালে বাজার করতে আসা গাজী তৈয়বুর রহমান বলেন, রমজানে যে দাম ছিল এখনও সেই একই দামে বিক্রি হচ্ছে তরিতরকারী।
আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, রমজান মাসে বাজারে মালামালের যে দাম ছিল এখন তার চেয়ে দাম আরো বেড়েছে। সামসুউদ্দিন ও মো. বাসারসহ স্থানীয় ক্রেতারা বলেন, সিন্ডিকেট আড়ৎদারদের কারণে এ বাজারে দাম বেশি। ক্রেতারা বলেন, আশপাশের বাজারের চেয়ে শহরের প্রধান এ বাজারে সব সময় পণ্যের দাম অনেক বেশি নেয়া হয়। স্বল্প দূরত্বে অন্য কোন বাজার না থাকায় একান্ত বাধ্য হয়ে এ বাজারে চড়া দামে তরকারি কিনতে এসে তাদের নাভিশ্বাস ওঠে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাইকারি কাঁচামাল বিক্রেতা আড়ৎদার সিন্ডিকেটের মূলহোতা আলম তালুকদার। তার সাথে রয়েছেন কবির, ফিরোজ, জামাল, নাসির, রফিক, সুমন, জাহিদ। এ চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে পুরো বাজার। এদের অনেকেই কাঁচামালের ব্যবসার নামে সিন্ডিকেটের আড়ালে অল্প দিনেই বিপুল অর্থ, গাড়ি, বাড়ির মালিক হয়েছেন। এ চক্রটি সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। যখন যে রাজনৈতিক নেতা প্রভাবশালী থাকেন তখন তাকে ম্যানেজ করে চক্রটি দিনের পর দিন সিন্ডিকেট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, চক্রটি প্রভাবশালী ব্যক্তি, বাজার মনিটরিং কমিটি ও স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় সদস্যকে ম্যানেজ করায় দিনকে দিন বেপরোয়া সিন্ডিকেট চালিয়ে আসছে।
মোংলা কাঁচা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলম তালুকদার বলেন, বাজারে কোন সিন্ডিকেট নেই, সবই উড়ো কথা। তারা পাইকারিতে যে দামে পণ্য কেনেন তার চেয়ে সামান্য বেশি দামে খুচরো ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। আর খুচরা বিক্রেতারা বলেন, আড়ৎ থেকে যে দর দেয়া হয় তার চেয়ে সামান্য কিছু বাড়িয়ে আমরা বিক্রি করে থাকি। দাম বাড়ানো কিংবা কমানোর বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। আমরা যে দামে কিনি তার চেয়ে সামান্য বেশি দামে বিক্রি করে আসছি।
মাঝেমধ্যে বাজার মনিটরিংয়ে স্থানীয় প্রশাসন অভিযানে নামে। অভিযোগ রয়েছে, অভিযানকালে দু একটি জরিমানা ছাড়া তেমন কোন ব্যবস্থা সাধারণত নেয়া হয় না।
উপজেলা বাজার মনিটরিং কমিটির অন্যতম সদস্য ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নুর আলম শেখ বলেন, মোংলা বাজারে কাঁচামালের দাম লাগামহীন হওয়াতে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। কাজেই মূল্য নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজার মনিটরিং জরুরি।
মোংলা পোর্ট পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুর রহমান বলেন, সিন্ডিকেট যারা করে তাদের দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য শেষ করার জন্যে তিনি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
উপজেলা বাজার মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপংকর দাস বলেন, এ বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।