ইকবালের বোতল বাড়ি!

0

আলী আকবর টুটুল,বাগেরহাট ॥ ৭০ হাজার পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের নানা রঙের বোতল দিয়ে একতলা বাড়ি তৈরি করছেন বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী দলের খেলোয়াড় ইকবাল হোসেন। বাড়িটি দেখতে প্রতিদিন শ শ মানুষ ভিড় করছেন। এটি অন্য পাকা ঘরগুলোর চেয়েও শক্তিশালী এবং নিরাপদ ও ভূমিকম্প প্রতিরোধক আবাসস্থল।
ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণকারী বাংলাদেশ ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ ক্রিকেট দলের সদস্য শারীরিক প্রতিবন্ধী ইকবাল হোসেন। বাগেরহাটের বলইবুনিয়া ইউনিয়নের কালীকাবাড়ী গ্রামের মৃত ইলিয়াস হোসেনের ছেলে ইকবাল হোসেন (৩০)। পেশায় ক্রিকেট খেলোয়াড়। পিতার আড়াই শতক জমির ওপর জাপানি প্রযুক্তিতে এ বাড়ি তৈরি করছেন। ইউটিউব দেখে কুড়ানো প্লাস্টিকের ৭০ হাজার পরিত্যক্ত বোতল ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনেন। যার ওজন ৯শ কেজি। এই বোতল দিয়ে তৈরি করেছেন তিনতলা ফিাউন্ডেশনের একতলা ভবন । ইটের বদলে সারি সারি প্লাস্টিকের বোতলে সিমেন্টের গাঁথুনি দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে এসব দেয়াল। শখ করে বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে বোতল বাড়ি। শুরুর দিকে বোতল দিয়ে বাড়ি নির্মাণের এমন পদ্ধতি দেখে হাসি-তামাশা করলেও এখন বাড়িটি নিয়ে গর্ব করে এলাকাবাসী।
স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা এসব বোতল বস্তায় ভরে ট্রাকে করে এনে মজুত করেন ইকবাল। জানতে চাইলে বলেন, বাড়ি বানাব। প্রথমে এসব নিয়ে অনেক হাসি-তামাসা হলেও এখন সত্যিই বাড়ি বানানো হয়েছে। এমন বাড়ি জেলায় মাত্র একটি। বাড়িটি দেখতে অনেকে আসেন।
এদিকে অভিনব পদ্ধতিতে বাড়ি নির্মাণের কাজ করতে পেরে খুশি রাজমিস্ত্রী ও শ্রমিকরা। খুলনার রাজমিস্ত্রী খোকন তরফদার বলেন, ১০ বছর ধরে রাজ মিস্ত্রির কাজ করি। বোতল দিয়ে বাড়ি বানানো এটাই প্রথম। বাড়ির নির্মাণ কাজ খুবই মজবুত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ির কোনো ক্ষতি হবে না। ইট-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি পাকা বাড়ির চেয়ে অন্তত ৩০ শতাংশ কম খরচে এ বাড়ি নির্মাণ করা করা সম্ভব। বিভিন্ন ভাঙারির দোকান থেকে বোতল কিনে সেগুলোর ভেতরে বালু ভর্তি করে সিমেন্টের গাঁথুনি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেয়াল। বালুভর্তি এসব বোতল দিয়ে মাটির নিচ থেকে আড়াই ফুটের বেশি ভিত তৈরি করে এর ওপর দেয়ালের গাঁথুনি দেয়া হয়েছে। বাড়িটির দেয়াল গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা আর শীতে গরম থাকবে বলে জানান তিনি। গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে নির্মাণাধীন বোতল ঘরের কাজটি শুরু হয়। দুই হাজার ৬শ স্কয়ার ফুটের চারপাশে চারটি রুম বিশিষ্ট এ ভবনটি। প্রতিটি রুমেই বোতলের সাজসজ্জায় বাংলাদেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও ইংরেজি শব্দে বাংলাদেশ লেখা। ভবনের একতলার কাজ শেষ করতে এক লিটার ও আধা লিটারের প্রায় ৭০ হাজার বোতল লাগবে। এ কাজের জন্য ৫৫ টাকা কেজি দরে ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে খালি বোতল কিনছেন ইকবাল হোসেন।
পারিবারিক সুত্রে জানাগেছে, হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য ইকবাল হোসেনের বাবা নেই। দশম শ্রণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ছোট বেলায় পোলিও আক্রন্ত হয়ে প্রায় অচল হয়ে যায় ইকবাল হোসেনের জীবন। উরু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত চিকন হয়ে যায়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমে চান্স হয়ে যায় ইকবালের। এরপর থেকে একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেছেন দেশে ও দেশের বাইরে। কিন্তু জাতীয় টিমে খেললেও পরিবারের আর্থিক কষ্ট দূর হয়নি ইকবালের। খেলার পাশাপাশি খুলনার একটি খাবার হোটেলে কাজ করে মা। ভাঙা ঘর নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন যায় মা ও ছেলের। ২০২০ সালে ইকবাল হোসেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াসেক মোহাম্মদ আলীর নজরে পড়েন। ইকবাল হোসেন বলেন, ওয়াসেক মোহাম্মদ আলী তাকে স্বাভাবিক জীবনযাপন ও একটি নিরাপদ আবাসন তৈরি করার জন্য সাড়ে ৪ লাখ টাকা দেন। এছাড়াও টানা এক বছর প্রতিমাসে ৭ হাজার টাকা করে সংসার চালাতে খরচ দিয়েছেন। ওই টাকা দিয়েই ব্যতিক্রমী ডিজাইনে বসতবাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেছেন তিনি। বাড়িটি নির্মাণ করতে এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আরও ২ লাখ টাকা লাগবে ছাদসহ একতলার কাজ শেষ করতে। টাকার অভাবে এখন কাজ বন্ধ আছে। একতলার কাজ শেষ হলে ঝুপড়ি ঘর ছেড়ে বৃদ্ধা মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে ওই ঘরে উঠবেন বলে জানান তিনি।
বাগেরহাট জেলা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কর্মকর্তা আবু জাফর সিদ্দিক বলেন, ফেলে দেওয়া প্লাস্টির বোতল দিয়ে তৈরি করা বাড়িটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব । এ ধরনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।