নানান তদবিরে প্রশ্নের মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোর কমিটির কতিপয় নেতা

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কতিপয় নেতার বিতর্কিত আচরণে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে যশোরের ছাত্ররা। লেখাপড়া ছেড়ে অফিসে অফিসে ক্ষমতার পাহারাদারের ভুমিকায় অবতীর্ণ এসব নেতা নানা অনৈতিক কাজে যুক্ত হচ্ছেন। প্রভাব বিস্তার, গণতদবির, দখলবাজি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, সরকারি সম্পদে ভাগ বসানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তারা। সুবিধাবাদীরাও তদবির কাজে ছাত্র সমন্বয়কদের ব্যবহার করছেন, আর সরকারি কর্মকর্তারা রীতিমত বিরক্ত হলেও লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে মুখ খুলছেন না। এদিকে কমিটি গঠনের দুই মাসের মাথায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোর জেলা সদস্যসচিব জেসিনা মোর্শেদ প্রাপ্তির পদ স্থগিত করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল¬াহ ও সদস্যসচিব আরিফ সোহেলের সই করা এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোর জেলা আহ্বায়ক রাশেদ খান।
সম্প্রতি যশোরে ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা বৈষম্যবিরোধীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। গত ২২ জানুয়ারি বুধবার জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে যশোরে তারুণ্যের উৎসব সেমিনার মঞ্চে জায়গা না পেয়ে ডিসি পদত্যাগ চেয়ে মিছিল করে ছাত্ররা। পরে সার্কিট হাউজে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ফিরোজ সরকার। তার আশ্বাসে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয় ছাত্ররা। তবে ওই বৈঠকে তারা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে কিছু অবান্তর দাবি তুলে ধরেন যা নিতান্তই তাদের ব্যক্তিস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ছিলো বলে জানাগেছে।
গত ২৪ ডিসেম্বর মধু মেলার টেন্ডার নিয়ে কালেকটরেট ভবনেরই বিক্ষোভ ও হাতাহাতির মত ঘটনা ঘটে। বৈষম্য বিরোধীদের পাশাপাশি একটি ছাত্র সংগঠনও এতে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও সড়ক সংস্কারের দাবিতে সড়ক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে অসৌজন্য আচরণ করে ছাত্রদের একাংশ। ফ্যাসিস্টের সুবিধা ভোগী এক ঠিকাদারের গোপন ষড়যন্ত্রে ছাত্ররা সম্মানী ব্যক্তিদের অস্মানিত করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যশোর জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, তারা এখন ছাত্রদের বহুমুখী তদবিরের চাপে রয়েছেন। আগে রাজনৈতিক নেতারা তদবিরে এগিয়ে থাকলেও জোরালো ভাবে ছাত্ররা এগিয়ে রয়েছে। প্রতিদিন কর্মকালীন সময়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা সরকারি দপ্তরে এসে নানা বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করছে।
তিনি বলেন, ছাত্ররা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ফ্যাসিবাদমুক্ত করেছে ঠিকই। কিন্তু তাদের বাড়তি আবদার মানতে গিয়ে আমাদের চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে। এসব বিষয়ে ছাত্র সমন্বয়কদের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রশাসনের আরেকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করার শর্তে বলেন, শুরুর দিক থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা প্রশাসনের নানানভাবে সহযোগিতা করেছে। বিশেষ করে শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের সহায়তা, বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং, শহরের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কাজে সহায়তার মধ্যে যুগান্তকারী কাজ করে বেশ প্রশংসার কুড়ায় তারা। কিন্তু এখন তারা একেবারেই উল্টো পথে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মতো প্রায় প্রতিদিনই তারা প্রশাসনিক দপ্তরে আসছেন নানা তদবির নিয়ে। ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়া, বিভিন্ন সরকারি অনুদানে ভাগ বসানোসহ নানা কাজে বাড়তি চাপ দেয় এসব শিক্ষার্থীরা। আবার পান থেকে চুন খসলেই তারা সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতা বলেন, আমরা এমন কিছু কাজ করে ফেলছি, যেটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে অনেক ক্ষোভ জন্ম দিচ্ছে। দেশের বিদ্যমান সংকটে আমরা রাষ্ট্রের পাশে ছায়া হয়ে থাকতে গিয়ে নিজেরাই বিতর্কিত হয়ে পড়ছি। এটি প্রকাশ্যে বলতেও পারছিনা, আবার সহ্য করাও যাচ্ছেনা। তিনি বলেন, আমাদের বিতর্কিত কর্মকান্ডেও অনেক শিক্ষার্থীকে মিছিল-কর্মসূচিতে ডাকলে আগের মতো উপস্থিত হতে চাচ্ছেনা। বাধ্য হয়ে হতাশাজনক উপস্থিতি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করছি। অথচ এক সময় এই যশোর শহরে ৫ থেকে ১০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে বিক্ষোভ করেছি।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোর জেলার আহবায়ক রাশেদ খান পতিত সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের মত বলেছেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। তবে কারোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন, মাঝেমধ্যে এমনকিছু অভিযোগ আমাদের কাছে আসছে। যে কারণে গত সোমবারের এক সভায় এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সংগঠনটির জেলা সদস্য সচিব (স্থগিত) জেসিনা মুর্শিদ প্রাপ্তি বলেন, ৫ আগস্টের পর নাগরিক অধিকার ও সংকটে কথা বলার জন্য জাতীয় প্লাটফর্ম হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের দায়িত্বপালন করার কথা। এজন্য জনগনের কাজের সুবিধার জন্য ছাত্ররা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ যদি তার ব্যক্তিস্বার্থে, নিজের আখের গোছাতে জুলাই বিপ্লবের মর্যাদাশীল এ সংগঠনকে কলঙ্কিত করে তার দায়িত্ব সংগঠন বহন করবে না। এজন্য ছাত্রদের প্রশাসনের লেজুড়বৃত্তি না করে জুলাই বিপ্লবের চেতনা বাস্তবায়নের সতর্ককতার সাথে দায়িত্বপালন করা উচিৎ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জেসিনা মুর্শিদ প্রাপ্তির পদ স্থগিত সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলা কমিটি গঠন সংক্রান্ত সাংগঠনিক নীতি বহির্ভূত কর্মকান্ড নজরে আসে কেন্দ্রীয় কমিটির। যার পরিপ্রেক্ষিতে জেসিনার পদটি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের জন্য ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটির সামনে জেসিনাকে সশরীরে উপস্থিত হওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।’

তদন্ত কমিটির ৩ সদস্য হলেন- আশরেফা খাতুন, ওয়াহিদুজ্জামান ও আকরাম হোসাইন রাজ। তারা সবাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক নেতা বলেন, সর্বশেষ জেসিনার বিরুদ্ধে ঝিকরগাছার কমিটি গঠন নিয়ে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে যশোর জেলার ৫৮ জন নেতার সই করা একটি লিখিত অভিযোগ পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় কমিটিতে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি যশোরে তদন্ত আসেন দুই কেন্দ্রীয় নেতা।
এদিকে পদ স্থগিত হওয়া সদস্যসচিব জেসিনা সাংবাদিকদের জানান, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। যেহেতু কেন্দ্রীয় কমিটি তাকে হাজির হওয়ার জন্য বলেছে তিনি সেখানে জবাব দেবেন।
গত ২৬ নভেম্বর রাশেদ খানকে আহ্বায়ক এবং জেসিনাকে সদস্যসচিব করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১০১ সদস্য বিশিষ্ট যশোর জেলা কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। কিন্তু কমিটিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসনসহ নানা অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন ও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ৯ নেতা পদত্যাগ করেন ছয় মাসের জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত এ কমিটি থেকে।