যশোরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে, আমন চাষ ব্যাহত, টিউবওয়েলে উঠছে না ঠিকমতো

0

 

তহীদ মনি ॥ বৃষ্টির অভাবে বর্ষাকালের শেষ প্রান্তে পৌঁছালেও যশোরে পানির জন্য হাহাকার অবস্থা। শতাধিক হেক্টর জমি আমন চাষের অপেক্ষায়। অনেক কৃষক সেচ পাম্প ব্যবহার করে আমন ধানের জমিতে পানি দিয়ে জমি প্রস্তুত করতে বাধ্য হচ্ছে। পানির লেয়ার নেমেছে প্রায় ২৩ ফুটের কাছে। অনেক টিউবয়েলে পানি ঠিকমত উঠছে না যেমনটি হয়ে থাকে এপ্রিলের দিকে। অনেকেই স্বভাবিক টিউবয়েল বাদ দিয়ে শর্ট লেয়ারওয়ালা টিউবওয়েল ব্যবহার শুরু করেছে। বৃষ্টির জন্যে কোথাও কোথাও হচ্ছে বিশেষ নামাজ আদায়। সহসা ব্যপক বৃষ্টি না হলে তীব্র খরায় ও পানি অভাবে যশোরাঞ্চল মরুময় হয়ে উঠবে। যশোরের কৃষি বিভাগ ও বিএডিসি পানির সমস্যার কথা স্বীকার করে বৃষ্টির অপেক্ষা আছে।
যশোর সদর এলাকায় আজ ভূগর্ভস্ত পানির লেয়ার ছিল ২২ দশমিক ৬ ফুট। এমনটিই জানালেন বিএডিসি‘র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সেচ) মো. আব্দুল্লাহ আল রশিদ। তিনি জানান, এই সময় সাধারণত পানির লেয়ার ৩ফুটের মধ্যেই থাকে। টিউবওয়েলে পানির সংকট হয় না। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে পানির স্তর সাধারণত ২২-২৪ ফুটে নেমে আসে। ২৬ ফুটের নিচেয় নামলে স্বাভাবিকভাবে টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। ফেব্রুয়ারি মার্চে স্যালো টিউবওয়েল ব্যবহার শুরু করে বোরো চাষিরা ফলে এপ্রিল থেকে পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নেমে যায় এবং অনেক এলাকায় স্ধারণ টিউবওয়েলে পানি ওঠে না, লেয়ার ফেল করে। এই ভরা বর্ষা মৌসুমে এমনটি হওয়ার কথা নয় অথচ এবার বৃষ্টি ঠিকমত না হওয়ায় পানির স্তর এখনই ২২ দশমিক ৬ ফুটে নেমেছে। কৃষকরা সেচ পাম্প চালিয়ে আমন চাষাবাদ শুরু করেছে এটা স্বভাবিক অবস্থা নয়।
যশোর উপশহরের বিদ্যুৎ মিস্ত্রি খোকন জানালেন মোটর দিয়ে টিউবওয়েলে পানি পাচ্ছে না কয়েকটা বাড়িতে এমন সমস্যায় তিনি তাদের শর্ট লেয়ারের টিউবওয়েলে সংযোগ দিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেন মোটরের সমস্যা নয় পানি যতটুকু পাচ্ছে তাতে ২/ ৩ তলায় সে পানি টেনে তুলতে পাচ্ছে না মোটরে। একই রকম বিষয় জানালেন বেলতলা জেল রোডের পাইপ মিস্ত্রি শহীদুল ইসলাম। তিনি বললেন, অনেক বাড়ির টিউবওয়েল মোটর থেকে পানি পাচ্ছে না, স্বভাবিকভাবে টিউবয়েল থেকে পানি ওঠাতে বেগ পেতে হচ্ছে। পানির লেয়ার ফেল করায় এমন হচ্ছে। উপশহর ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকায় মোটর মিস্ত্রি আব্দুল হামিদ জানান, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মোটরের খবর পেয়েছেন যা দিয়ে তারা পানি তুলতে পারছে না। গৃহবধূ আরজু জানান, তাদের মোটর দিয়ে টিউবওয়েল থেকে ট্যাংকিতে পানি তুলতে পারছেন না ৩ দিন। অবশেষে শর্ট লেয়ারের টিউবওয়েলটা চালু করিয়ে নিয়েছেন মিস্ত্রি দিয়ে। এ পানি ময়লা, ঘোলা ও গন্ধযুক্ত। কাপড় কাচা, খাওয়া কোনোটাই করা যায় না। খাওয়ার পানির জন্যে যে টিউবয়েলটা ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে একজগ পানি তুলতে খুব কষ্ট করতে হচ্ছে।
এদিকে যশোরের মণিরামপুর, চৌগাছা, বাঘারপাড়া, কেশবপুর,অভয়নগর উপজেলার অনেক চাষির সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখনো পানির অভাবে আমনের জমি পাকাতে পারেন নি। বীজতলা শুকিয়ে ধানের চারা লাল হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছেন। কোনো কোনো ্এলাকার মানুষ বৃষ্টির জন্যে বিশেষ নামাজ আদায় করছেন বলেও কৃষকরা জানান। অনেক চাষি জানান, পানি অভাবে তারা পাট জাগ দিতে পারছেন না। বর্ষার এ সময়ে খালে, বিলে, ডোবা, নালা বা পুকুরে পর্যাপ্ত পানি থাকে, পাট জাগদিতে(পাট পচাতে) সমস্যা হয় না, আমন রোপণেও সমস্যা হয় না। এ বছরের মতো এমন শুকনো মৌসুম বর্ষাকালে তাদের জীবনে দেখেননি বলেও জানান কৃষক ও চাষিরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে পাটের সমস্যা তো হয়েছেই, ধান উৎপাদন না হওয়ায় চাষিরা না খেয়েই মারা যাবে এমন আশঙ্কা তাদের। তাদের মতে এতে ঘরে ঘরে অভাব বাড়বে। পাট, ধান পর পর দুটো ফসল এভাবে বৃষ্টি অভাবে মারা গেলে স্বভাবিক জীবন যাত্রার উপায় থাকবে না।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো.মঞ্জুরুল হক জানান, যশোরে এবার আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৪৭ হেক্টর। সাধারণত যশোরে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে আবাদ বেশি হয়। আমনের ঋতু হিসেবে অন্য বছর ৮০ শতাংশের বেশি জমি রোপণ সম্পন্ন হয়। অথচ এবার এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমন রোপণ হয়েছে। তিনি জানান, গত কয়েক বছর একটু দেরিতে ভারী বর্ষা হচ্ছে তবে এতদিনে পানি থাকে জমিতে। এবার ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ধান রোপণের সময় মেনে নিচ্ছে কৃষি বিভাগ। তারপরও জেলার লক্ষ্যমাত্রার এক সপ্তমাংশ জমিতে আপমন রোপণ হয়নি। অবশ্য তিনি আশাবাদী, আগামী কিছু দিনের মধ্যে ভারী বৃষ্টি হলে আমনে আর ব্যঘাত ঘটবে না। ইতোমধ্যে অনেক কৃষক সেচ পাম্পের সহায্যে ভূগর্ভস্ত পানি উঠিয়ে চাষাবাদ শুরু করেছেন।
কৃষিবিদ মো.মঞ্জুরুল হক বলেন, নিকট অতীতে বড় বৃষ্টি হয়েছে ৩০ জুলাই রাতে। সে সময় যশোরে ১৪ সেন্টিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর আগে এ বছর এত ভারী বৃষ্টি হয়নি। খুব শিগগিরই এমন ভারী বৃষ্টি হবে এবং কৃষকরাও আমন আবাদ করতে পারবেন বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তবে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা আতঙ্কিত, তাদের মতে বৃষ্টি আরো দেরিতে হলে খুবই ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। পানির লেয়ার না পেলে সেচ পাম্পও চলবে না। এখনি যদি স্যালো দিয়ে পানি ওঠাতে হয় তা হলে, শুকনো মৌসুম, শীত মৌসুমে টিউবওয়েলে মোটেই পানি থাকবে না। মরুময় অবস্থার সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যে যে সব টিউবওয়েলে পানি কম উঠছে বা যারা মোটর দিয়ে ট্যাংকিতে পানি তুলতে পারছেন না তারা আরো ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে যাচ্ছেন বলেও আশঙ্কা করছেন।