ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, সীমাহীন দুর্ভোগে যশোরবাসী

0

 

আকরামুজ্জামান ॥ দিন যতই যাচ্ছে ততই যশোরে বিদ্যুতের লোডশেডিং ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। মাত্র দুদিন আগেও শহরের পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও এখন দিন দিন তার অবনতি হচ্ছে। দিনরাতে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়েই চলছে। আর গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও ভয়ানক পর্যায়ে রয়েছে। সেখানে দিনরাত মিলে তিন-চার ঘন্টাও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে প্রচ- গরমে মানুষের যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনি আমন আবাদ, মাছের রেণু-পোনা তৈরি করতে হ্যাচারি মালিকরা হিমশিম খাচ্ছে। মারাত্মক সমস্যায় পড়েছেন যারা সেচচালিত স্যালো মেশিনে আমনের প্রস্তুত নিচ্ছেন। ভেঙে পড়া এ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনরাও শঙ্কিত। সহসা এ পরিস্থিতি উন্নতি হবে না বলে জানাচ্ছেন তারা।
পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন বিভাগ ওজোপাডিকো-যশোরের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ শহিদুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুতের চাহিদার ক্ষেত্রে আমরা যা পাচ্ছি তা সরবররাহ করতে গিয়ে লোডশেডিং বাড়ছে। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগেও আমাদের দুটি ইউনিটে বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে যে সরবরাহ ছিলো তা অনেকটা সন্তোষজনক। এখন তা একটু কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেড়ে যাচ্ছে। দিনের বেলায় ৪ থেকে ৫ বার পর্যন্ত লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বলেন, পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন ওজোপাডিকো-যশোরের আওতায় যশোর সেনানিবাস, বিমান বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থাকায় বিদ্যুৎ সরররাহের ক্ষেত্রে সব সময় সচেতন থাকতে হয়। ওজোপডিকোর দুটি জোনের আওতায় রোববার বিদ্যুতের চাহিদা ছিলো ৬০ মেগাওয়াট অথচ সেখানে সরবরাহ দেয়া হয় মাত্র ৩৪ মেগাওয়াট । যে কারণে যশোর শহর ও আশপাশের এলাকায় লোডশেডিং বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, একদিকে যেমন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, তেমনি সরবরাহ কমছে। এর আগে বিদ্যুতের চাহিদা যখন ৫৫ মেগাওয়াট ছিলো তখন আমরা ৩৫ থেকে ৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতাম। এখন প্রায় প্রতিদিনই কম পাচ্ছি। এ কারণে লোডশেডিং বাড়ছে।
যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির-১ এর জেনারেল ম্যানেজার আবু বকর শিবলী বলেন, বিদ্যুতের ক্রাইসিস এখন জাতীয় পর্যায়ে রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের হাতে আসলে কিছু নেই। আমাদেরকে যেটুকু বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে সেটুকুই গ্রাহক পর্যায়ে দিয়ে দিচ্ছি। চাহিদার চেয়ে কম পাওয়ায় লোডশেডিং তীব্র হচ্ছে। তিনি বলেন, শনিবার দিনগত রাতে আমাদের দুটি জোনের আওতায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিলো ২২৪ মেগাওয়াট। অথচ সরবরাহ ছিলো ১৪০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ৮৪ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েন এ দুটি জোনের গ্রাহকরা। রাতের পর পরদিন রোববার দিনের বেলায় এই দুটি জোনে সর্বোচ্চ চাহিদা ছিলো ১৬৮ মেগাওয়াট। সেখানে সরবরাহ দেয়া হয় ১০২ মেগাওয়াট। অর্থাৎ রোববার দিনের বেলায় সর্বোচ্চ ৬৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিলো। তিনি বলেন, যশোর শহরের একটি অংশের পাশাপাশি আশপাশের কয়েকটি জেলার গুরুত্বপূর্ণ কিছু সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা রয়েছে পল্লী বিদ্যুতের-১ ও ২ এর আওতায়। যে কারণে এসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে অনেকটা সতর্ক থাকতে হয়। এসব কারণে গ্রামে লোডশেডিংয়ের একটু চাপ বাড়ছে। তিনি বলেন, সহসা বিদ্যুতের উন্নতি হবে কি-না বলতে পারবো না। এটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ লোকেরা বলবেন। তবে আমরা সবসময়ই চাই বিদ্যুতের সরবরাহ ঠিক থাকুক। গ্রাহকরা ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে আমাদের দেশেও তেলের দাম কমে যাবে। আর তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সহজ হয়ে গেলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা কমতে থাকবে।
এদিকে বিদ্যুতের ভয়াবহ এই লোডশেডিংয়ের কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে গ্রামের লোকজন। সেখানে দিনের বেলায় ৭ থেকে ৮ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। শ্রাবণের বৃষ্টিহীন তীব্র গরমে মানুষের কষ্টের সীমা থাকছে না। মানুষের কষ্টের পাশাপাশি মারাত্মক সমস্যায় পড়েছেন যারা আমন চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় এ বছর মাঠে-ঘাটে পানি না থাকায় বিলম্বে এসে চাষিরা সেচের পানি দিয়ে আমন চাষের প্রস্তুতি নিলেও বিদ্যুৎ না থাকায় তারা সেচ দিতে পারছেন না। যারা ডিজেল চালিত স্যালো মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দিচ্ছেন তাদেরকে বাড়তি খরচ গুণতে হচ্ছে।
বাঘারপাড়ার প্রেমচারা গ্রামের শামীম আকতার বলেন, বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অবনতির কারণে আমরা চরম খারাপ অবস্থায় আছি। একদিকে যেমন তীব্র গরমে কষ্ট পাচ্ছি তেমনি চাষাবাদেও পিছিয়ে পড়ছি। তিনি বলেন, দিন-রাতে অধিকাংশ সময়ই বিদ্যুৎ থাকছে না। একবার গেলে তা ৪-৫ ঘন্টা পর আসছে। এ অবস্থায় মাঠে বিদ্যুতচালিত সেচ পাম্প দিয়ে জমিতে পানি দিতে পারছি না। তিনি বলেন, দিন যত যাচ্ছে ততই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।
অন্যদিকে বিদ্যুতের এই বিপর্যয়ের কারণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন যশোরের চাঁচড়ার মৎস্যপল্লীর হ্যাচারিগুলো। দিনে ৭ থেকে ৮ বার লোডশেডিং হওয়ায় হ্যাচারি মালিকদের ডিজেলচালিত সেচ পাম্প দিয়ে পানি তুলে মাছের রেণু ও পোনা তৈরি করতে হচ্ছে। এর ফলে তাদের বাড়তি খরচ গুণতে হচ্ছে। জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও চাঁচড়া মাতৃ ফিস হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী জাহিদুর রহমান গোলদার বলেন, এ বছর অনাবৃষ্টির কারণে আমরা মাছ চাষিরা এমনিতে কঠিন সংকটে আছি। তারপর এখন বিদ্যুতের লোডশেডিং মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। একদিকে বাড়তি বিদ্যুৎ বিল অন্যদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় আমাদের ডিজেল কিনে স্যালো মেশিন দিয়ে পানি তুলতে হচ্ছে। তিনি বলেন, গত কয়েকদিনও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকলেও এখন খারাপের দিকে যাচ্ছে।