শ্রদ্ধা ও শোকাবহে দাফন, যুবদল নেতা ধনি হত্যায় জড়িতরা আটক হয়নি

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোর জেলা জাতীয়তাবাদী যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান ধনি (৫৫) হত্যাকা-ের দুদিন পার হলেও জড়িত সন্ত্রাসীদের আটক করতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকারী সন্ত্রাসীরা আটক না হওয়ায় স্বজন ও এলাকাবাসী ছাড়াও দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। গত মঙ্গলবার দিনদুপুরে শহরের শংকরপুর চোপদারপাড়া আকবরের মোড়ে নিজ বাড়ির সামনে সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে যুবদল নেতা বদিউজ্জামান ধনিকে। তিনি একই এলাকার আব্দুল লতিফের ছেলে।
অপরদিকে যুবদল নেতা বদিউজ্জামান ধনিকে হত্যার ঘটনায় বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও কেন্দ্রীয় যুবদল নেতৃবৃন্দ তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন এবং জড়িত অপরাধীদের আটকের দাবি জানিয়েছেন।

যশোর জেলা ‍যুবদলের সহসভাপতি বদিউজ্জ্জামান ধনী

নিহতের ভাই মনিরুজ্জামান মনি বলেন, তার ভাই ধনি শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। গত মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১ টার দিকে তিনি নিজ বাড়ির কাছে বৌরানী ফার্মেসির সামনে বসেছিলেন। এ সময় আচমকা কতিপয় সন্ত্রাসী এসে তার ওপর চড়াও হয়। এর মধ্যে ছিলো নিহত সন্ত্রাসী ইয়াছিনের ফুফাতো শ্যালক রায়হান। ধনি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ইয়াছিন হত্যার সাথে তিনি কোনো প্রকার জড়িত ছিলেন না। তাকে না মারার জন্যও আকুতি জানান ধনি। কিন্তু তার কথা না শুনে ধনিকে উপর্যুপরি কোপায় ওই সন্ত্রাসীরা। পরে তারা সেখান থেকে চলে গেলে স্থানীয় লোকজন ও স্বজনরা তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে তার মৃত্যু হয়। মনিরুজ্জামান মনি বলেন, সন্ত্রাসী হামলায় ইয়াছিন খুন হওয়ার পর ধনিকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছিলো। কিন্তু ধনি এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলায় আসামি করা হয়েছিলো। এ ঘটনার পর ধনি সতর্কতার সাথে চলাফেরা করতেন। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তাকে প্রাণে বাঁচতে দিলো না। পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ধনি বৌরানী ফার্মেসির সামনে যখন বসেছিলেন তখন সেখানে আসে ইয়াছিনের আপন শ্যালক ফয়সাল। সে তাকে দেখার পর ফোনে বিষয়টি অন্যদের জানিয়ে দেয়। এর পরপরই সন্ত্রাসীরা সেখানে এসে ধনিকে উপর্যুপরি কোপায়। প্রাণ বাঁচাতে দক্ষিণ পাশ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন ধনি।

কিন্তু দক্ষিণ পাশে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন ইয়াছিনের শ্বশুর মানুয়া। তার ব্যারিকেড হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে পালাতে পারেননি ধনি। কারা হত্যাকা-ের সাথে জড়িত এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুজ্জামান মনি বলেন, তিনি রায়হানকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে পালাতে দেখেছেন। রায়হান বেজপাড়া ফুড গোডাউনের দক্ষিণ পাশের ফরিদের ছেলে এবং নিহত ইয়াছিনের ফুফাতো শ্যালক। এছাড়া হত্যার সাথে একই এলাকার মিরাজ বিশ্বাসের ছেলে মন্টু বেজপাড়া টিবি ক্লিনিক এলাকার মৃত রইচের ছেলে আলামিন ওরফে চোর আলামিন, শংকরপুর হারান বস্তির বাবুর ছেলে ইছামির ও শংকরপুর চোপদারপাড়ার আলিমের ছেলে আকাশসহ কয়েকজন জড়িত রয়েছে।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ধনির পেটসহ শরীরের নিচের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের অসংখ্য কোপের চিহ্ন ছিলো। হাসপাতালে ভর্তির পর দুপুর ১২ টা ৪০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক ইয়াসিন ফাহিদ তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বাবলু কিশোর জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ক-সার্কেল বেলাল হোসাইন বলেন, ইয়াছিন হত্যাকা-ের জের ধরে এই হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় প্রভাব বিস্তার করাকে কেন্দ্র করে একটি পক্ষ তাকে হত্যা করেছে বলেও তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। হত্যার সাথে জড়িত রায়হানসহ অন্যদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের আটকের জন্য পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে সন্ত্রাসী হামলায় যুবদল নেতা ধনি গুরুতর জখম হওয়ার খবর শুনে সাথে সাথে হাসপাতালে যান বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। তিনি সার্বক্ষণিক সেখানে অবস্থান করে তার চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছিলেন। এছাড়া হাসপাতালে যান জেলা বিএনপির আহবায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগম, সদস্য সচিব অ্যাড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, যুগ্ম আহবায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন, বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান খান, আব্দুর সবুর মণ্ডল, নগর বিএনপির সভাপতি রফিকুল ইসলাম চৌধুরী মুল্লুক চাঁদ, কোতয়ালি থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আঞ্জুরুল হক খোকন, বিএনপি নেতা মুনীর আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এহসানুল হক সেতু, কাজী আজমসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।


দলীয় সূত্রে জানা যায়, ময়নাতদন্ত শেষে বিকেল পৌনে পাঁচটায় নিহত ধনির লাশ লালদিঘিপাড়স্থ জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে নিয়ে আসা হয়। এখানে কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে দলের খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, যশোর জেলা বিএনপির আহবায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগমের নেতৃত্বে নেতৃবৃন্দ ছাড়াও দলটির কোতয়ালি থানা, নগর শাখাসহ বিভিন্ন উপজেলা বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর একের পর এক শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের পক্ষ থেকে।


সন্ধ্যার পর ঢাকা থেকে আগত কেন্দ্রীয় যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মামুন হাসান, সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার নিহত যুবদল নেতা বদিউজ্জামান ধনির বাসভবনে যান। তারা সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করেন এবং শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। একই সাথে তারা যুবদল নেতা বদিউজ্জামান ধনি হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানান। তারা বলেন, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে এই হত্যার বিচার করা হবে।
অন্যদিকে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু হত্যাকা- সম্পর্কে বলেন, ’বদিউজ্জামান ধনি একজন আপাদমস্তক রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তিনি সামাজিক কর্মকা-ের সাথে জড়িত ছিলেন। এলাকায় তার জনপ্রিয়তা ছিলো। আমরা বিশ্বাস করতে পারিনা তার মতো একজন নির্ভেজাল মানুষ খুন হতে পারেন। আমরা চাই পুলিশ প্রশাসন সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত খুনিদের আটক করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাক।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এই হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানাই। পাশাপাশি ওই এলাকায় আর কেউ খুন হোক তা আমরা চাইনা।’


অপরদিকে গতকাল বুধবার বেলা ১১ টার দিকে শংকরপুর সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নিহত যুবদল নেতা বদিউজ্জামান ধনির নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, কেন্দ্রীয় যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মামুন হাসান, সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র মারুফুল ইসলাম, দৈনিক লোকসমাজের প্রকাশক শান্তনু ইসলাম সুমিতসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও এলাকার শ’ শ’ মানুষ অংশ নেন। পরে বেজপাড়া কবরস্থানে শোকাবহ পরিবেশে দাফন করা হয় বদিউজ্জামান ধনিকে।
এদিকে গত মঙ্গলবার একটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী হত্যা মিশনে অংশ নেয়া চোর আলামিনকে ধরে নিয়ে গেছে বলে এলাকায় প্রচার রয়েছে। এছাড়া বুধবার দুপুরে বেজপাড়ার মাদক ব্যবসায়ী সগিরের ছেলে নাদিমকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে এমনটা জানিয়েছেন এলাকাবাসী। একইদিন দুপুরে শংকরপুর ইসহাক সড়কের একটি বাড়ি থেকে হত্যা মিশনে অংশ নেয়া সন্ত্রাসী রায়হানের স্ত্রী ও মাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ নিয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। তবে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ক-সার্কেল বেলাল হোসাইন জানান, কাউকে পুলিশ আটক করেনি।

হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত রায়হান

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত রায়হান ও ফয়সাল গত মঙ্গলবার রাতে বেজপাড়ার মাদক ব্যবসায়ী সগিরের ছেলে নাদিমের ঘরে আত্মগোপন করেছিলো। পরে ভোরে তারা সেখান থেকে অন্যত্র চলে যায়।
পুলিশ জানায়, তারা রায়হানসহ হত্যা মিশনে অংশ নেয়া অন্যদের আটকের জন্য অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। কোতয়ালি থানা পুলিশের ইনসপেক্টর (তদন্ত) শেখ মো. মনিরুজ্জামান জানান, রায়হানের বিরুদ্ধে চাঁদাবজি, পর্ণোগ্রাফি, মাদক ও অস্ত্র সংক্রান্ত আইনে মোট ৪টি মামলা রয়েছে।