যশোর শিক্ষা বোর্ডে চেক জালিয়াতি আত্মস্বীকৃত অপরাধী সালামের দেয়া সাবেক চেয়ারম্যানসহ ৪ কর্মকর্তার নাম চেপে যাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ

0

 

তহীদ মনি ॥ যশোর শিক্ষা বোর্ডের আলোচিত সাড়ে সাত কোটি টাকা চেক জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাট ও দুর্নীতির ঘটনায় সাময়িক বহিষ্কৃত আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত বোর্ড এখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। এদিকে, তদন্ত বোর্ড গঠনের আগে আব্দুস সালামকে দেওয়া কারণ দর্শানো নোটিশের লিখিত জবাবে সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেনসহ ৪ জন কর্মকর্তাকে জড়িয়ে অভিযোগনামা ও স্বীকারোক্তি দিলেও অজ্ঞাত কারণে তাদের নাম এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেনো তাদের নাম আসলো তা জানতে কোনো কমিটিও গঠন করা হয়নি।
আব্দুস সালামের দেওয়া লিখিত জবাবে যাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের নামটাও জানাতে রাজি নন বোর্ড কর্মকর্তারা। এ নিয়ে শিক্ষা বোর্ডের কর্মচারীদের মধ্যে নানা গুঞ্জন রয়েছে। অনেকেই মনে করেন এতে অপরাধ চেপে যাওয়া হচ্ছে। তাছাড়া গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সালামের বিরুদ্ধে চাকরি থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের জন্যে তদন্ত বোর্ড গঠিত হলেও অদ্যাবদি কাজ শেষ না হওয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে শিক্ষা বোর্ডে।
সূত্র মতে, গত বছর অক্টোবর মাসে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেক জালিয়াতি ও অর্থ লোপটের ঘটনা ধরা পড়ে। মোট ৩৮টি চেকে প্রায় সাড়ে ৭ কাটি টাকার জালিয়াতি, লোপাট ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা হয়। ওই সময় বিভিন্ন পত্রিকা ও গণমাধ্যমে বিস্তারিত খবর প্রকাশ হয়। তৎকালীন শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান ও সচিবকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়। ওই সময় এই অর্থ লোপাট ও জালিয়াতির সাথে শিক্ষা বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তার নামও চাউর হয়। বোর্ডের বাইরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় শিক্ষা বোর্ড গঠিত তদন্ত কমিটি ও দুদক। সব মিলিয়ে বিশাল হই-চই পড়ে যায় সে সময়।
এর এক পর্যায়ে শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন হিসাব সহকারী মো. আব্দুস সালাম এ ঘটনার দায় স্বীকার করে লিখিত দেন এবং মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে ২ দফায় প্রায় ৩১ লাখ টাকা শিক্ষা বোর্ডে ফেরত দেন। সে সময় আব্দুস সালামকে তার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দীর্ঘদিন পর তাকে স্থায়ী বহিষ্কারের পদক্ষেপ হিসেবে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠায় শিক্ষা বোর্ড।
গত ফেব্রুয়ারিতে পাঠানো নোটিশের লিখিত জবাব দেন আব্দুস সালাম। ওই চিঠিতে তিনি সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন, সহকারী প্রকৌশলী মো. কামাল হোসেন, প্রশাসনের সহকারী সচিব মোহাম্মদ মুজিবুল হক এবং সেকশন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাকিব হোসেনকে অভিযুক্ত ও জড়িত বলে জানান।
চলতি বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে এ লিখিত জবাবে জড়িতদের নাম পাওয়ার পর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ চিঠির নামগুলো চেপে যায়। এমন কী যাদেরকে জড়িয়ে এ চিঠি তাদেরকেও জানতে দেয়নি বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে শিক্ষা বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ‘বর্তমান চেয়ারম্যান সাবেক চেয়ারম্যান বন্ধু বিধায় তাকে বাঁচাতে চিঠিটি চেপে যাচ্ছেন।’ তাছাড়া সালামের বিষয়ে গঠিত তদন্ত বোর্ড সময়ক্ষেপণ করছে। অনেকেই মনে করছে থলের বিড়াল বেড়িয়ে পড়ার ভয়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ এ পন্থা বেছে নিয়েছে। তাদের মতে, চলতি জুন মাসে শিক্ষা বোর্ডের কমিটি বিলুপ্ত হবে। নতুন কমিটি গঠিত হতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। তারা এসে পুরাতন ফাইল চালু করতে করতে তদন্ত বোর্ড প্রধান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মাধব চন্দ্র রুদ্রর চাকরির মেয়াদ শেষ হতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষা বোর্ডে চাপা ক্ষোভ ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ চিঠির বিষয়টি না জানালেও তার অংশ বিশেষ এই প্রতিবেদকের হাতে পৌঁছেছে সেখানে গত ৯ মার্চ ২২ তারিখের লিখিত জবাবে আব্দুস সালাম নিজে ব্যাংকে টাকা জমা দেয়নি দাবি করে বলেছেন, ওই টাকা সাবেক চেয়ারম্যান তার কাছে পাঠিয়ে ব্যাংক ম্যানেজারকে ফোন করে জমা করার কথা বলেন। সালাম চেয়ারম্যানের কথা মতো, তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্ট থেকে ১১ লাখ টাকা ওঠানোর কথা বলেন এবং অবশিষ্ট ৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা চেয়ারম্যানের প্রতিনিধির মাধ্যমে সালামের কাছে পাঠিয়ে ব্যাংক ড্রাডফটের মাধ্যমে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা ১৮/১০/২০২১ তারিখে জমা দেন। তিনি চিঠিতে আরও জানান, গত ১০/১০/২১ তারিখে ড. মোল্লা আমীর হোসেন টাইপ করে মো. কামাল হোসেন, মোহাম্মদ মুজিবুল হক ও মোহাম্মদ রাকিব হাসানের মাধ্যমে দরখাস্ত পাঠান। তারা এসে জানান, যদি তুমি দোষ স্ বীকার করে নাও তাহলে চেয়ারম্যান তোমাকে মাফ করে দেবেন এবং কোনো পুলিশ কেস হবে না। তোমার চাকরি বহাল থাকবে। তাই সালাম সেলিদন দোষ স্বীকার করে লিখিত দেন। বোর্ড সংশ্লিষ্টদের দাবি এমন লিখিত জবাব পাওয়ার পরও শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক্ষ অভিযুক্তদের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত শিক্ষা বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী মো. কামাল হোসেন বলেন, অপরাধ স্বীকার করে নেয়া একজন অপরাধী নতুন করে বিভিন্ন জনের নাম জড়িয়ে লিখিত জবাব দিয়েছেন এটা তার জানা নেই। তবে একজন আত্মস্বীকৃত অপরাধীর অন্যদের জড়ানো দুঃখজনক। তার মতে কোনো পক্ষ তাকে প্রভাবিত করে এ কাজ করাচ্ছে। ‘আপনারা কেনো সালামের অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার নন ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বোর্ড তো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চেক জালিয়াতি ধরা পড়ার প্রথম দিিেকও এই নামগুলো শোনা গিয়েছিল। এমন কথার জনাবে কামাল হোসেন বলেণ, আব্দুস সালামের স্বীকারোক্তিমুলক ও টাকা জমাদানের পর অবসর অভিযোগ অর্থহীন। মো. রাকিব হোসেন জানান, আব্দুস সালামের এমন একটি জবাবের কথা কান কথা হিসেবে তিনি শুনেছেন। তবে বোর্ড কর্তৃপক্ষ কিছু জানায়নি। তার মতে, আব্দুস সালাম নিজে বাঁচার জন্য বিভিন্ন জনকে জড়াচ্ছে। এর জন্যে তিনি বিচলিত নন। তার মতে, মোল্লা স্যারের নির্দেশে কাজ করতাম বেল একটি পক্ষ ফাযদা লুটার চেষ্টা করছে। আব্দুস সালাম যা বলেছেন, তার প্রমাণ হতে হবে। তদন্ত বোর্ডের প্রধান ও পরীক্ষ নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মাধব চন্দ্র রুদ্র জানান, অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সাথে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এই তদন্ত বোর্ডের রায় ও সুপারিশের পর একমাত্র আদালত ছাড়া অন্য কোথাও কোনো অপ্রীতিকারের ব্যবস্থা থাকবে না। তাই ক্ষতিগ্রস্তপক্ষ আইন-আদালতের কোনো একটি ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাক তা তদন্ত বোর্ড চায় না। এ কারণে দেরি হলেও নিয়মিত গুরুত্বের সাথে কাজ করা হচ্ছে। তিনি জানান, এই তদন্ত বোর্ডের কাজ সুনির্দিষ্ট। তা হলো সাময়িক বরখাস্তকৃত সাবেক হিসাব সহকারী মো. আব্দুস সালামের অপরাধ বিশ্লেষণ, সংশ্লিষ্টতা, তার দেওয়া জবাব ও অন্যান্য ঘটনা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া। আব্দুস সালামের দেওয়া লিখিত জবাবে যদি অন্যদের াম এসে থাকে সেটি বিচারের কাজ এই তদন্ত বোর্ডের না। সাময়িক বহিষ্কৃত আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার উত্তর খোঁজা ও যাচাই-বাছাই করা। বিষয়টি জটিল, সে কারণে কিছুটা সময় লাগলেও অচিরেই চূড়ান্ত সিদ্ধ্তা গ্রহণ করে ফাইলটি ক্লোজ করার চেষ্টা করছি। চিঠিতে কাদের নাম আব্দুস সালাম উল্লেখ করেছেন এটা জানানোর এখতিয়ার তার নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। সামগ্রিক বিষয়ে যশোর শিক্সা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহসান হাবীব জানান, চিঠিতে আব্দুস সালাম যাদের নাম জড়িয়েছে, তদন্ত বোর্ডের কাজ শেষ হওয়ার পর সেটি নিয়ে ভাবা হতে পারে। শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ তখন যদি প্রয়োজন বোধ করে তবে চিঠিতে ব্যবহৃত নাম ও তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আসবে। চিঠিতে চেপে যাচ্ছেন কাউকে বাঁচানোর জন্য কীনা এমন প্রশ্নর জবাবে শ্কিষা বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, বাঁচানো বা মারার বিষয়টি এটি নয়। এমন এক ধরনের কাজ চলছে এর মধ্যে এটা যেমন আনা যাবে না তেমনি তদন্তাধীন অবস্থায় ওই চিটির কারো নাম বা কোনো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে না। ফেব্রুয়ারিতে গঠন করা তদন্ত বোর্ডের কাজ জুনেও শেষ হয়নি এমন মন্তব্যের জবাবে চেয়ারম্যান জানান, বিষয়টির সবদিক পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তার মতে, সিদ্ধান্ত দেরিতে হোক তবে, সেটা সঠিক হোক।
বোর্ডে প্রচার রয়েছে- আপনি সাবেক চেটয়ারম্যানকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। এমন বিষয়টিকে তিনি আবারো উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি’।