শিল্পী অনিল কুমার চৌহান মসজিদে কুরআনের আয়াত এঁকে পুরস্কৃত

0

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ
শিল্পীরা সাম্প্রদায়িকতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। তারই প্রমাণ রেখেছেন ভারতের হায়দ্রাবাদের ক্যালিগ্রাফার অনিল কুমার চৌহান।
গেল বছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর দিনে মসজিদে ক্যালিগ্রাফি শিল্পে অবদানের জন্য এই শিল্পী রহমত আলম আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
চৌহান তার শিল্পের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বন্ধনকে দৃঢ় করতে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। শহরের মসজিদগুলোতে তাঁর ক্যালিগ্রাফির কাজ মানুষের ঐক্য ও শৈল্পিক প্রকাশের সর্বজনীনতার প্রতি বিশ্বাসের সাক্ষ্য বহন করছে।
চৌহানের জীবন দীর্ঘ আর ধৈর্যশীল সংগ্রামের একটা প্রাণবন্ত উদাহরণ; যা জগতের মনুষ্যজীবের অভিব্যক্তি ও ভক্তির এক জাজ্জ্বল্য প্রমাণ।
অনিল কুমার চৌহান একজন অমুসলিম ক্যালিগ্রাফার। তিনি ২০০টিরও বেশি মসজিদে কুরআনের আয়াত, আসমা মোবারক লিখেছেন। তিনি ক্যালিগ্রাফির আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পাননি; এমনকি উর্দু বা আরবি অধ্যয়ন করেননি। তথাপি এই দুটি ভাষায় তাঁর কাজ অনবদ্য ও নিশ্চিদ্র।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল অল ইন্ডিয়া বজম রহমত আলম, যা একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এদের লক্ষ্য মানবতার সেবা ও ধর্মীয় সমাজ গঠন নিশ্চিত করা।
কলকাতার বিখ্যাত আলেম মাওলানা শামীমুজ্জামান কাদরী মসজিদে কুরআনের আয়াত লেখায় অবদানের জন্য চৌহানকে ৬ষ্ঠ রহমতে আলম আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার প্রদান করেন।
অনিল কুমার চৌহান স্বেচ্ছায় বিনা পারিশ্রমিকে ১০০ টিরও বেশি মসজিদে কুরআনের আয়াত ও আশীর্বাদপূর্বক নাম (আসমাউল হুসনা: আল্লাহ্র পবিত্র নামসমূহ) লিখেছেন।
একইভাবে চৌহান আদালত ও মঠগুলিতেও তাঁর ছাপ রেখেছেন। তিনি ক্যালিগ্রাফিতে পারদর্শিতা দেখাতে ও হায়দ্রাবাদের অন্যতম বিখ্যাত শিল্পী হতে উর্দু,আরবি লিপিতে দক্ষতা অর্জন করেছেন।
বজম রহমত আলম মিলাদুন্নবী উপলক্ষে অনিল কুমার চৌহানের ক্যালিগ্রাফির একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করে।
সবসময় শিল্পী চৌহান তাঁর সৃজনশীল কর্ম প্রদর্শনী করতে আগ্রহী ছিলেন, আর তাই তিনি শেষ পর্যন্ত নবীর জন্মবার্ষিকীতে এটি করতে পেরে খুশি। কয়েশ অংশগ্রহণকারী তার কাজের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন, সাথে সাথে তার এ প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন। অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে অনেক অমুসলিমও ছিলেন।
দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে শত শত মানুষ প্রদর্শনী দেখেন। অনিল কুমার চৌহান অনুষ্ঠানে আরো প্রাণযোগ করেন নাত (নবীর প্রশংসায় রচিত গান) পরিবেশন করে।
চৌহান পুরস্কারটি পেয়ে খুবই খুশি। তিনি সিকি শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে এ দায়িত্ব পালন করছেন।
তাঁর এ শিল্পের দীর্ঘ ভ্রমণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়া নিজামিয়া থেকে একটি ফতোয়া (ডিক্রি) পেয়েছিলেন। ওই ডিক্রিতে তাঁকে মসজিদে কুরআনের আয়াত লেখার অনুমতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, তাঁর একাজে ধর্ম বাধা নয়।
তিনি সেই সময় থেকে নিয়মিতভাবে মসজিদ ও দরগায় কুরআনের আয়াত ও বরকতময় (আশীর্বাদপূর্ণ) নাম লিখছিলেন। তিনি বলেন, মানুষ তার প্রতি অনেক সম্মান প্রদর্শন করেন।
অনিল আরো বলেন, “একজন শিল্পীকে উৎসাহিত করা সমাজের দায়িত্ব।” তিনি বজম রহমত আলমের কর্মকর্তাদের পুরস্কার প্রদান ও প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
শিল্পী জানান যে, তিনি উর্দু ভাষার সাথে পরিচিত নন। এর কারণ স্রেফ তিনি একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন। যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে এই ভাষাটি তাঁর শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয়, তখন তিনি দিনরাত চর্চা করেন।
শুরুতে তিনি উর্দু বুঝতেন না। কিন্তু পরে এর মাধুর্যের কারণে এই ভাষার প্রেমে পড়ে যান। তিনি আরবি ভাষার পাশাপাশি উর্দুতে ক্যালিগ্রাফি শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেন।
চৌহান বিশ্বাস করেন যে ভাষা কখনই একটি জাতি বা ধর্মের সাথে যুক্ত হতে পারে না; কারণ “ভাষা হৃদয়কে সংযুক্ত করে।”
তাঁর মতে একজন শিল্পীর কোন ধর্ম নেই; তিনি তার শিল্পের মাধ্যমে সকলের হৃদয় জয় করেন। তিনি শুধুমাত্র তাঁর শিল্পের জন্য মানুষের সম্মান ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন।
শত মসজিদে অবৈতনিক সেবা প্রদান ও কুরআনের আয়াত লেখা আধ্যাত্মিকতার অনুভূতি দেয়; আধ্যাত্মিক কেউ তাকে তার কাজের জন্য পারিশ্রমিক দাবি করা থেকে বিরত রাখেন।
চৌহান শিল্পপ্রেমী আর ধনী ব্যক্তিদের শিল্পীর প্রশংসা ও উৎসাহ দিতে বলেন।
এই গুণী শিল্পী কাজ করতে গিয়ে অনেকবার বিপদে পড়েছেন। তার মধ্যে এরকম একটি অভিজ্ঞতা হচ্ছে-একবার একটি মসজিদে ক্যালিগ্রাফির কাজ শেষ করে তিনি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলেন। নামতে নামতে হঠাৎ সিঁড়িটি ভেঙে পড়ে তিনি একটি স্তুপের মধ্যে গিয়ে পড়েন। এর পরের অভিব্যক্তি তাঁর এই যে , “মনে হচ্ছিল সিঁড়িটা অপেক্ষা করছিল আমার কাজ পর্যন্ত। তারপর সে ভেঙে পড়বে। আসলে ওই ঘটনায় আমি বোবা হয়ে গেছিলাম। এই ঘটনায় আমি ঐশ্বরিক উপস্থিতি অনুভব করি। মনে হচ্ছিল ঈশ্বর আমার কাজে সন্তুষ্ট।”
যাইহোক, তাঁর সন্তানরা বাবার পথে হাঁটেনি। পেইন্টিং বা ক্যালিগ্রাফি নেয়নি। তাঁর যুবক ভাই তাঁকে সাহায্য করে। দুই সন্তান উভয় গ্রাজুয়েট হয়ে বেসরকারি সেক্টরে নিয়োগপ্রাপ্ত।
তাঁর আফসোস ‘ক্যালিগ্রাফি শেষ হয়ে যাচ্ছে। খুব অল্প সংখ্যক লোক যারা এটা জানে তাদের অনেক চাকরির সুযোগ নেই।’
এটা সত্য শিল্পী তাঁর কাজের মাধ্যমে হয়ত বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেননি। কিন্তু তিনি অনেক মানুষের কাছ থেকে প্রচুর ভালোবাসা ও সম্মান অর্জন করেছেন। তিনি সারা জীবন হায়দ্রাবাদের পুরনো শহরে বসবাস করছেন ও মুসলমানদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মসজিদে কাজ করছেন আর নাত গাইছেন।
“ধর্মের নামে আজ যে পরিবর্তনগুলি হচ্ছে তার জন্য আমার খারাপ লাগছে। প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের পছন্দের ধর্ম পালনের অধিকার আছে। কেন কেউ ধর্মের নামে জোর করে বা বিভক্ত করে ” আফসোস শিল্পীর।
তবে আরেকটা মজার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। একবার বেশ কয়েকজন মুসলমান তাকে মসজিদে কাজ করতে দেখে ইসলামের দাওয়াত দেন। তিনি বলেন “আমি ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করি ও তারা চলে যান। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু লোক জেদ করে। তারপর আমি তাদের বলি, ইসলাম ধর্মে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। যখন তারা এই কথা শোনে, তারা এটা জেনে চুপ করে যায় যে এটাই সত্য।”

লেখক: কবি, অনুবাদক ও গবেষক