মহান শহীদ ও ভাষা দিবস সংখ্যা-২০২২

0

ম.ম.রবি ডাকুয়ার দুটি কবিতা

কিছু প্রত্যাশার ভাষা

বছর বছর মানুষের কষ্টের ভাষা বড় হয়,

বলতে চাওয়া না বলা ভাষা জড়ো হয়।

চোখ ছলছল জ্বলজ্বল ভাষা,

জল হয়ে গড়িয়ে পড়া ভাষা।

বাঁচার জন্যে আর্তনাদের ভাষা,

সব একত্রিত চির অম্লান আশার ভাষা।

ভেসে যাওয়া চোখের জলের ভাষা,

সহস্র তৃষ্ণার কষ্টের অতলের ভাষা,

আয়েশে ভরা দুচোখে তির্য্ক বাঁকা কটাক্ষের ভাষা।

সোনা ঝরা অক্ষরে ভাষা,

পুরনো জং আর দেয়ালে নোনা ঝরা ভাষা,

দরিদ্র মানুষের নীরবতার ভাষা,

সব ভাষা লুকিয়ে রেখে নীরব কেবল কিছুই প্রত্যাশা।

লক্ষ কোটি প্রাণের ভাষা ফিরিয়ে দিল রফিক, জব্বার,

তবু বিকৃত ভাষা স্বীকৃতি পায় বার বার।

ভাষার উচ্ছাসে

সারা পৃথিবীর মানচিত্রে সবশেষ

একটাই ভাষার যুদ্ধের দেশ,

কোটি প্রাণে ফিরিয়ে দিল যে ভাষার গানে,

রক্তের কালিতে ব্যথার তুলিতে

আমরাই লেখি ভাই হারা শতাব্দীর সে পংক্তির গান।

ভাষার আশ্বাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাসে,

দিবস-রজনী যে ভাষায় সুর ছড়াতে জানি।

বইয়ের উচ্চারণের আগে ভাষা,

বাদামের ঠোঙা হয়ে যায়।

স্বীকৃত ভাষা তবু বিকৃত,

ফুসফুস যকৃতের মত ধুলো- ধোয়ায় হয় বিক্রিত।

অপেক্ষা সব সময় ফটকে, কিছু আসার বা পাবার,

অপেক্ষা তাই ছটফট করে বারবার।

অস্তিত্বের মাঝে গাড়ো হারানো বেদনা আরো,

পাবার ভাষা শুধুই চাওয়া,

ভাষা আছে যে পথে,

কত মনের ভাষা থাকে নেপথ্যে।

শিকড় থেকে অক্ষর তুলে

আবার বহ্নিশিখা মশাল জ্বেলে।

তবু ভাষা নিয়ে কত সংগ্রাম,

ভাষা পাবার উচ্ছাসে হাসে শহর-গ্রাম।

নির্যাতনের মতো স্নেহ
আকিব শিকদার
মায়ের কিছু আচরণ মারাত্মক
পীড়া দিতো আমায়। আমি এর নাম রেখেছিলাম
নির্যাতনের মতো ¯েœহ।
ধরা যাক, বন্ধুবান্ধবে আড্ডা। ফোনে যন্ত্রণার ঝড় তুলে
মা জানতে চায়Ñ শরীরটা ভালো কি না? খেয়েছি কি না সসময়ে?
বাড়িতে নিজ হাতে খাওয়াতো; আমার মোটেই
লাগতো না ভালো। অনার্স পড়–য়া ছেলে
মায়ের হাতে ভাত খাচ্ছেÑ কী লজ্জা!
গোসলখানার দরজায় ঠক-ঠক। তোয়ালেতে সাবান মেখে
উপস্থিত মা। পিঠে কালি-ময়লার চর, ঘষেমেজে
তুলবে যখন, আমি সুরসুরি পেয়ে দলাই-মলাই।
হঠাৎ যদি অসুখ বাঁধতো, যেমন সামান্য জ¦র,
মা রাত জেগে ছেলের মাথায় ঢালতেন জল। ভেজা কাপড়ে
জুড়াতেন কপালের উত্তাপ। তার চোখভরা অশ্রু দেখে
রাগে তো আমার দাঁত কটমট।
কোথাও যাবার বেলায় মা উঠোন পেরিয়ে
রাস্তা অব্দি আসতো। ক্ষণে ক্ষণে বলতোÑ ‘সাবধানে থাকিস’।
আঁচলের গিঁট খুলে হাতে দিতো তুলে
খুচরো পয়সা কিছুÑ পথে পড়বে প্রয়োজন।
রিকশাতে উঠে মায়ের উদ্বেগী মুখটায়
তাকাতেই খুব কষ্টে জমতো কান্না
চোখের কোণায়। মাঝে মাঝে নিঃশব্দে চলে আসতাম।
তার এক বদভ্যাস, যাত্রাকালে ¯্রষ্টার নামে
আমার কপালে দেবে অন্তত তিনটি ফুঁ…
এতে নাকি বিপদের ছায়া কাটে, কুগ্রহের কালগ্রাস থেকে
বাঁচবো আমি। ওসবে বিন্দুমাত্র ছিলো না বিশ^াস, তবু
একদিন বেজেউঠা ফোন রিসিভ করতেই
শশ্বব্যস্ত মায়ের গলাÑ ‘রিকশাটা
থামা বাবা, তোর মাথায় তো ফুঁ দেওয়া হয়নি’।
আবদার রাখতে প্রথম বাসটা মিস, দ্বিতীয়টায়
চড়ে বসলাম। বাস ছুটছিল
বাতাস কাটা বেগে; আচমকা কড়া ব্রেকের ঝাঁকুনিতে
যাত্রিরা থতোমতো। বাইরে ভীর, শহরগামী প্রথম গাড়িটা
পড়ে আছে ব্রিজের নিচে, আর প্রায় সব কয়
যাত্রীই নিহত। আহা… এতোক্ষণে হয়ে যেতাম ওপারের বাসিন্দা।
মায়ের মৃত্যুর পর আজই প্রথম
বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছি। এতোবার পিছু তাকালাম, মায়ের মুখটা
দেখতে পেলাম না; বড়ো উদ্বিগ্ন চিন্তাশঙ্কুল সেই মুখ
কোনদিন দেখা হবে না এই পৃথিবীতে।
মা… মা গো… তোমার সন্তানের ওপর থেকে
সকল বিপদের ছায়া, কুচক্রির কুনজর কি কেটে গেছে…!
একটি বার কেনো আসো না তবে
দিতে মঙ্গল ফুঁ…! কেন পিছু ডেকে বলো নাÑ
‘এই নে খুচরো কয়টা টাকা, পথে কিছু কিনে খাস’।

 

আট-ই-ফাগুন
নাজমা আক্তার
একুশ মানে আটই ফাগুন
ইংরেজিটা না বলি
লড়াই করলাম বাংলার জন্য
সালাম বরকত নাম স্মরি।
ফাগুন মাসে আগুন মেখে
শিমুল, পলাশ সাজ সাজিয়ে
এই ফাগুনে শহিদ মিনারে
ভরে যায় ফুলে ফুলে।
ফাগুন দিল মায়ের বুলি
চাই হারানো শোকগুলি
বায়ান্নতে ভাইয়ের বুকে
পাক সেনারা দেয় গুলি।
ভাষার মাসে বর্ণমালা
বীর শহিদের নাম স্মরি।
একুশ গেলে সব চেতনা
কিš‘ কেন যায় মরি।

 

জেগে ওঠা তীর
সা’দ সাইফ
অপেক্ষাকৃত উঁচু ডালে কৃষ্ণচূড়ার ফুল,
বেরিয়ে আসছে থরে থরে বারুদ।
অথবা বহমান পথে খুনস্রোত,
জীবন্ত ক্যাকটাস কিংবা মরীচিকা
ফেটে পড়ে দৃশ্যমান ফলাফলে।
নদীতে আঁকা তীব্র বাহুসঙ্কেত
অবারিত প্রতাপে নগ্নপ্রায়;
চলছে চলন্ত বিভীষিকা।
অদৃষ্ট ঘুর্ণন,মায়াবী টানে,
কেঁপে ওঠে যেন পুরো পৃথিবী।
ফিরে আসে নদীর স্বজোয়ার।
উন্মুখ তখনো আবির কৃষ্ণচূড়া।

শহিদ মিনার
অরূপ রতন মন্ডল

বেদীর উপর দাাঁড়িয়ে আছ নির্বাক-অর্ধবৃত্তাকার,
চেতনার অবিনাশী উৎস তুমি নিদর্শন মাতৃভাষার।
প্রেরণা তুমি সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার,
প্রতিবাদের প্রতীক তুমি, সুতিকাগার জাতীয়তার।
তুমি শ্রদ্ধার; শোক, শক্তি, গৌরবের শহিদ মিনার,
তুমি মহান, বিদ্রোহী, অমর; অগ্নিমশাল চেতনার।
তোমার হৃদয়ে ঘুমিয়ে ছিল বীজমন্ত্র স্বাধীনতার,
টগবগে তারুণ্যে তুমি ছিঁড়লে নাগপাশ পরাধীনতার।
প্রাণভ্রোমরা তুমি সংগ্রামের, ভালোবাসা বর্ণমালার,
শোষিতের বিজয় কেতন তুমি বাঙালির অহংকার।

মায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছ দু’পাশে চার সন্তান,
মাথা নত যেন বাংলার কুলবধূ তুমি অবগুন্ঠন।
ঊদিত সূর্য কিরণে ছড়িয়ে দিয়েছ ভোরের দ্যুতি,
মায়ের প্রতীকে তুমি মাতৃভূমি, এঁকেছেন ¯’পতি।
ভাষার জন্য আত্মত্যাগ স্মরণ করে আজ বিশ্ববাসী,
অক্ষয় তুমি শহিদ মিনার, ধন্য সব বাংলাভাষী।