একজন হৃদয় মণ্ডল

0

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা॥ গোপনে শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ফোন নিয়ে শিক্ষকের আলাপচারিতা রেকর্ড করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়া হলো, তার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলা হলো, ২২ বছর ধরে সুনামের সাথে বিজ্ঞান পড়ানো শিক্ষককে জেলে ভরে দেয়া হলো। এটাই একখণ্ড বাংলাদেশ এখন। মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ের সহকারী শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল আসলে অন্ধের দেশে চশমা বিক্রি করেছেন সারাজীবন। ভুলে ভরা জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল অজ্ঞানতার অন্ধকারে থাকা এক সমাজে বিজ্ঞান তথা আলোর কথা বলা। হৃদয়হীন সমাজে হৃদয় উজাড় করে তিনি জ্ঞান বিতরণ করতে চেয়েছিলেন।সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা বা দাঙ্গা কেবল মানুষের প্রাণ কিংবা সম্পত্তি ধ্বংস করে না; সৌভ্রাতৃত্ববোধ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতির মধ্যেও চিড় ধরায়, সাধারণ মানুষের ঐক্যকে নষ্ট করে, তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং সেই সঙ্গে জ্বলন্ত সমস্যাগুলো থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেয়। তাই উন্নয়ন যদি আমাদের স্পৃহা হয়ে থাকে তাহলে সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে সরব হওয়ার কোন বিকল্প নেই।তেজগাঁও কলেজের নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষিকা লতা সমাদ্দারের টিপ নিয়ে এক পুলিশ সদস্যের অসদাচরণকে ঘিরে দেশ যখন উত্তাল তার আগে থেকেই হৃদয় মন্ডলকে ফাঁসাতে পেরে উদ্বেলিত ছিল তার ছাত্ররা। হৃদয় মন্ডল ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরবেন বলে তার স্ত্রী আর সন্তানেরা যখন অপেক্ষা করছিল, তখন তারা জানল প্রিয় মানুষটি পুলিশি হেফাজতে এবং তারা নিজেরাও নিরাপদ নয়। বাড়ি এসে এই ধার্মিক ছাত্ররা খিস্তি খেউড় করে সদর্পে ফিরে গেছে। এতটুকু ছেলেরা এতটা সাম্প্রদায়িক কী করে হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে শুধু এটুকু বলা যায় খুব গভীর থেকে বাংলাদেশে তালিবানিকরণের প্রচেষ্টা চলছে। খুব ছোট ছোট শিশুরা এখন হিন্দু মুসলমান বিভাজন করতে শিখে গেছে। কারও প্রতি অন্যায় হলে হিন্দু শব্দটিও লেখা হয় না। লিখতে হয় সংখ্যালঘু।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ইতিহাস সুপ্রাচীন। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা হলো শিক্ষিত সমাজের সাম্প্রদায়িকতা। তারা যে কোনো প্রকারে দুর্গাপূজায় হামলার যৌক্তিকতা খুঁজে পায়, কিছু না পারলে বলবে ভারতেও তো মুসলিমরা নির্যাতিত হয়, যেন ওখানে হয় বলে সেই কাজ এখানেও জায়েজ। এরা নিজের সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে ব্রিটিশ আর কানাডীয় কারিকুলাম পড়ায় কিন্তু ফেসবুকে মাদরাসা শিক্ষার প্রসারে শোরগোল করে। এরা নিজেরা ধর্মের কোনো আচরণই ঠিকমতো চর্চা করে না, কিন্তু স্বাধীনতার কথা বলে সাধারণ নারীর সাধারণ পোশাক নিয়ে নিয়মিত কটূক্তি করে। স্বাাধীন যুক্তিবাদী চিন্তার একটা ধারা বরাবর মুসলিমদের মধ্যে ছিল। ইসলামি সভ্যতার প্রারম্ভিক পর্বে এক যুক্তিবাদী গোষ্ঠী ছিল। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আধুনিকতার পথে চলতে শুরু করেছে, উদারতার চর্চা বাড়াচ্ছে। আর আমরা কেবল পাকিস্তার আর আফগানিস্তান হওয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত। আমাদেরও অনেক মুসলিম উদারপন্থি নেতা ও বুদ্ধিজীবী ছিলেন। খুঁজলে এখনও আনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু এই যুক্তিবাদীরা অন্ধকারের শক্তির সামনে মুখ খুলতেও ভয় পাচ্ছেন এখন। সাধারণ মুসলমান উদার। কতিপয় নেতা ধর্মব্যবসায়ী কট্টরবাদকে ব্যবহার করে ক্ষমতার রাজনীতি করেন। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে এই শিক্ষিত তালেবানিরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রসরাজ দাস, সুনামগঞ্জের ঝুমন দাস, ভোলার বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য, রংপুরের টিটু রায় আর মুন্সিগঞ্জের হৃদয় মন্ডল – প্রত্যেকেই অসত্য ঘটনার শিকার অতি সাধারণ শান্তিপ্রিয় নাগরিক। এর একটি বিহিত প্রয়োজন। ধর্মীয় অনুভূতির ক্ষমতা এতো বেশি যে, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকারও এই অনুভূতিওয়ালাদের সমঝে চলে। তাই সাম্প্রদায়িকতার অশুভ শক্তি যেভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শাসক দলকে সক্রিয় হতে দেখা যায়না। প্রতিবাদকারীরা সংখ্যালঘুর চেয়েও সংখ্যায় কম হয়ে দাঁড়িয়েছে সবখানে। ইতিহাস কোন কালেই প্রশ্ন ও বিচারের ঊর্ধ্বে ছিল না, হতে পারে না। তাই আজ যদি এসব অনাচারের বিরুদ্ধে, হামলার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমাজ না দাঁড়ায়, রাষ্ট্র না দাঁড়ায়, গণমাধ্যম না দাঁড়ায়, সংস্কৃতি না দাঁড়ায়, আগামী দিনে শতগুণ সহিংস হয়ে তাদেরই আক্রমণ করবে এই শক্তি। উন্নয়ন যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিকাশ যদি আমাদের আকাঙ্খা হয়, তা হলে সাম্প্রদায়িকতাকে আমাদের দূরে সরিয়ে রেখে এগোতে হবে। গত বছর দুর্গাপূজার সময় দেশব্যাপী লাগাতার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় মৌন থেকেছে। এই নিরবতা উন্নয়ন পরিপন্থি। কয়েক বছরের ঘটনাবলী প্রমাণ করে দেশে চলছে এক সংগঠিত সাম্প্রদায়িকতা। পরিস্থিতি এমন যে, সাম্প্রদায়িকতার অগ্রসৈনিকরা মর্যাদাবান হিসেবেও সুবিধা নিচ্ছে। হিন্দু বিরোধিতা বা নাস্তিক উপাধি দিয়ে মুক্তমনাকে খুন করার আড়ালে অহরহ লুকিয়ে থাকে শ্রেণিগত বিরোধ, রাজনীতি, ব্যবসায়িক অভিসন্ধি, গুন্ডাবাজি, মাস্তানি, জবরদখল ইত্যাকার নানাবিধ ফন্দি। নিজের ধান্দাতেই সে সব ফন্দিবাজরা নিত্যনতুন ফিকির খোঁজে; মওকা বুঝে ধর্মীয় জিগির তুলে উলুখাগড়া গোছের লোকদের লেলিয়ে দেয়। মৌলবাদ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, নৃশংস। এরা ধর্ম মানে না, কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে। এদের হাতিয়ার ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, উগ্রতা। এরা মানুষের আবেগকে উস্কে দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করে দেশকে রক্তাক্ত করে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা বা দাঙ্গা কেবল মানুষের প্রাণ কিংবা সম্পত্তি ধ্বংস করে না; সৌভ্রাতৃত্ববোধ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতির মধ্যেও চিড় ধরায়, সাধারণ মানুষের ঐক্যকে নষ্ট করে, তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং সেই সঙ্গে জ্বলন্ত সমস্যাগুলো থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেয়। তাই উন্নয়ন যদি আমাদের স্পৃহা হয়ে থাকে তাহলে সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে সরব হওয়ার কোন বিকল্প নেই। সম্প্রীতি ও ঐক্য রক্ষার তাগিদ সর্বত্র উচ্চারিত হোক।
লেখক: সাংবাদিক।