‘আমি পাঁচটা মার্ডার মামলা খেয়েছি,আইন শেখান আমারে’: যশোরের ইছালী স্কুলের প্রধান শিক্ষককে যুবলীগ নেতার হুমকির অডিও ভাইরাল

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোরের ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামকে হত্যার হুমকি ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সদর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মাজহারুল ইসলাম মাজহারের বিরুদ্ধে। তাকে মোবাইল ফোনে হুমকি দেয়া হয়েছে। গত ২৪ মার্চ এ ঘটনা ঘটলেও হুমকির অডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ায় সর্বত্র বিষয়টি জানাজানি হয়। প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম এ ঘটনায় গত ৩১ মার্চ জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে কোতয়ালি থানায় জিডি করেছেন। তবে যুবলীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম মাজহার আজ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের কাছে হুমকির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন, এটি তার বক্তব্য নয়। আর পুলিশ বলছে, জিডি তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সকালে সাংবাদিকরা ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখতে পান প্রধান শিক্ষক অনুপস্থিত। শিক্ষকরা জানান, হুমকি ধামকির ঘটনার পর থেকে প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে এলেও বেশিক্ষণ থাকেন না। তারা আরও জানান, গত ২৪ মার্চ দুপুরে যুবলীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম মাজহার বিদ্যালয়ে আসেন। অসুস্থতাজনিত কারণে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম এসময় বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। তার কক্ষে বসেই মাজহারুল ইসলাম মাজহার প্রধান শিক্ষককে ফোন করেন। তিনি প্রধান শিক্ষককে নতুন কমিটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে বলেন। কমিটির বিষয়ে মামলা চলমান রয়েছে বলে প্রধান শিক্ষক জানালে মাজহারুল ইসলাম মাজহার তাকে গালিগালাজসহ হত্যার হুমকি দেন।
এদিকে প্রধান শিক্ষককে দেয়া হুমকির অডিও রেকর্ড গতকাল সোমবার ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া অডিও’র কথোপকথনের প্রথমেই ওই যুবলীগ নেতা প্রধান শিক্ষককে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করেন।
যুবলীগ নেতা : স্যার কোথায় আছেন ?
প্রধান শিক্ষক : আমি অসুস্থ, বাসায় আছি।
যুবলীগ নেতা : কমিটির আবেদন করবেন না আপনি ?
প্রধান শিক্ষক : এখনো তো করিনি। আমি সুস্থ হয়ে নিই, দেখি কী করা যায়।
যুবলীগ নেতা : আমার এমপি সাহেব আমারে পাঠিয়েছে। এখন আমি আপনার স্কুলের চেয়ারের সামনে বসে আছি। ফরিদ ভাই আপনার বাসায় লোক পাঠাতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি বলেছি আপনি অসুস্থ, তাই আসেনি। ফিঙ্গে লিটনের গাঁজাখোর-ইয়াবাখোর ছেলেপেলে যেয়ে আপনার সাথে যদি খারাপ ব্যবহার করে তাহলে দায় পরবর্তীতে আমার ঘাড়েই আসে।
প্রধান শিক্ষক : না–খারাপ ব্যবহার করবে কেন ?
যুবলীগ নেতা : আপনি আর কথা বলবেন না। আপনার কোনো কথা জীবনে আর শুনবো না। আপনি কমিটির দরখাস্ত করবেন না, করবেন সেটা আপনাকে জানিয়েছি। কালকে এসপির সাথে কথা হলো, হাশিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কমিটি আপনার আরো তিনমাস পরে মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটি ইতোমধ্যে বের হয়ে গেছে। আপনি কার ক্ষমতায় এই কমিটির আবেদন করছেন না সেটা আপনাকে বলতে হবে। আর যদি না করেন, তাহলেও বলে দিতে হবে আমি এই কমিটির আবেদন করবো না। তারপরে আপনার সাথে বুঝবো পরে এই বিষয়ে।
প্রধান শিক্ষক : তুমি আমার কথা শুনবা না কেন ? তোমারে ফোন দিলেই তুমি কেটে দাও শুধু। আমার ফোনটা ধরতে হবে। আর কথাটা শুনতে হবে।
যুবলীগ নেতা : আচ্ছা বলেন বলেন ।
প্রধান শিক্ষক : আমি কী আবেদন করবো ? যারা মামলা করেছে তাদের সাথে তো আমার কথা বলা লাগবে নাকি ? মামলা তুলে দেওয়া লাগবে না ?
যুবলীগ নেতা : (উত্তেজিত কন্ঠে) আপনি আমারে মামলা বুঝান। আমার এই অল্প বয়সে আমি পাঁচটা মার্ডার মামলা খেয়েছি। আপনি আইন শেখান আমারে। ওই মামলার কাগজপত্র ছয় মাস পরে সব বাতিল হয়ে যাবে। আপনার কত বড় ক্ষমতা আপনি এমপি সাহেবের কথা শুনছেন না। সব মামলা আপনি করাচ্ছেন।
প্রধান শিক্ষক : না আমি করাতে যাবে কেন ? মামলা তুলে না নিলে কমিটির আবেদন করা যাবে না তো। তাই সবার সাথে কথা বলতে হবে। আমি বলবো, তুমি বলবা।
যুবলীগ নেতা : শুনেন স্যার, আমি কারোও সাথে কথা বলতে পারবো না। ২৪ ঘন্টার মধ্যে কার সাথে কথা বলবেন না কি বলবেন আপনি জানেন। আপনার কোনো মা বাপ (গণমাধ্যমে অপ্রকাশযোগ্য অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ) আছে তাদের সাথে কথা বলেন। ২৪ ঘন্টার মধ্যে কমিটি যদি আবেদন না করেন, তাহলে আপনি যদি যশোর থাকতে পারেন। তার পরে আমি চুড়ি পরে এই যশোরে ঘুরে বেড়াবো।
এরপর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হত্যার হুমকি ধামকি দেন ওই যুবলীগ নেতা (গণমাধ্যমে অপ্রকাশযোগ্য)।
তিনি আরও বলেন, তুই আজকের পর থেকে নীলগঞ্জে কীভাবে থাকিস দেখবানে। তোর লোকজন পুলিশ-র‌্যাব নিয়ে থাকিস। আমি আসছি।
এসময় প্রধান শিক্ষক বলেন, তুমি কথাবার্তা ভদ্রভাবে বলো। প্রতিউত্তরে যুবলীগ নেতা বলেন, আমরা যেভাবে ভদ্রতা দেখাই, তত ভদ্র কিন্তু আমি না।
প্রধান শিক্ষক : তুমি আমার ছাত্র ছিলে, এভাবে বলছো কেন ?
যুবলীগ নেতা এ সময় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে আবারো হুমকি দেন।
প্রধান শিক্ষক : কাউকে বলা লাগবে না। আমি সুস্থ হয়ে নেই। তারপরে দেখবানে।
যুবলীগ নেতা : তা তোর সুস্থ হওয়া লাগবে না। তুই কীভাবে যশোরে থাকিস আমি দেখবানে। তুই যদি যশোরে থাকতে পারিস, আমি আর যশোরে রাজনীতি করবো না। তোর চাকুরি থাকে কিনা দেখিস। তোরে এতোদিন কিছু বলিনি। এতোদিন ভদ্রতা দেখাইছি, তুই আমার স্যার তাই। এখনো অভদ্রতার কিছু দেখিসনি তুই। (অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে) তুই জামায়াত করে এখনো এই জায়গায় আছিস তোর কপাল ভালো এই বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন ওই যুবলীগ নেতা।
সহকারী প্রধান শিক্ষক আক্তারুজ্জামন বলেন, ‘যুবলীগ নেতা মাজহারুল স্কুলে এসে আমাদের সামনেই ফোন করে প্রধান শিক্ষককে শাসান। এরপর থেকে তিনি ভয়ে তটস্থ হয়ে আছেন। ঠিকমত স্কুল করতে পারছেন না। আমরাও ভীত। আমরা স্কুলে পাঠদান করতে আসি। আমাদের সাথে এমন আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
ডিবি পুলিশ কার্যালয়ে আজ দুপুরে এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আগের কমিটির অগোচরে যুবলীগ নেতা মাজহার ও তার সহযোগীরা এডহক কমিটির সভাপতি হিসাবে মনিরুজ্জামানকে নিযুক্ত করেন। এতে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও অভিভাবকরা ওই কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনাসহ একজন অভিভাবক হাইকোর্টে মামলা করেন। বর্তমানে এই মামলাটি চলমান রয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে মাজাহারুল তাকে কমিটির জন্য আবেদন করতে বলছেন। তিনি বলেন, মামলাটি নিষ্পত্তি হলে কমিটির আবেদন করা হবে। কিন্তু মাজহারুল তা মানতে চাইছেন না। যে কারণে মাজহারুল তাকে ফোন করে হুমকি ধামকি দিয়েছেন। এ ঘটনায় প্রধান শিক্ষক গত ৩১ ডিসেম্বর যশোর কোতয়ালি থানায় জিডি করেছেন। প্রধান শিক্ষক আরো বলেন, কথোপকথনের অডিও ভাইরাল হওয়ার পর ডিবি পুলিশের ওসি তাকে ফোন দিয়ে দেখা করতে বলেছেন। যে কারণে তিনি ডিবি অফিসে এসেছেন। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের জন্য প্রশাসন, শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
অভিযোগের বিষয়ে যুবলীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা রাজনৈতিকভাবে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অনলাইনে একটা নিউজ আছে। ওটা যশোরের একটা রাজনৈতিক গ্রুপ তারা চালায়। আপনারা জানেন যশোরে গ্রুপিং রাজনীতি আছে। স্যারের সাথে যে সমস্ত বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে, প্রথমে আমি তারে সালাম দিছি। কমিটি নিয়ে অনেকদিন ধরে হাত পা ধরাধরি হচ্ছে। ওইদিন আমাকে স্কুলে ডাকায় নিয়ে গেছে। যেয়ে দেখি উনি নাই। আমি ফোন দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করিছি। পরবর্তীতে ওই কথাগুলো দেওয়া হয়েছে। ওই কথাগুলো আমার না। আমি যতটুকু বলিছি সেই কথার সাথে ওই কথার কোনো মিল পাচ্ছিনা।’ ডিবি পুলিশের ওসি রুপন কুমার সরকার জানান, প্রধান শিক্ষককে ডাকার পর জানতে পারেন তিনি এ ঘটনায় জিডি করেছেন। ফলে এ নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি। কোতয়ালি থানা পুলিশের ওসি মো. তাজুল ইসলাম বলেন, জিডি তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করতে হয়। তাই ওই জিডি তদন্ত করতে আদালতে আবেদন করা হয়েছে।