‘বিচার পাই না, তাই চাই না’

0

প্রভাষ আমিন॥ মতিঝিল-শাহজাহানপুর এলাকার রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা বোধহয় হিন্দি বা তামিল সিনেমা একটু বেশিই দেখেন। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের স্টাইল দেখে আমার এমন ধারণা হয়েছে। তাদের খুনেও রয়েছে সিনেমাটিক স্টাইল। ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডের গেটে সবার সামনে খুন হয়েছিলেন মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক মিল্কী। সিসিটিভির আওতায় থাকায় সেই খুনের দৃশ্য সবাই দেখেছেন। ঈদের জমজমাট মার্কেটে সবার সামনে এমন খুনের দৃশ্য দেখলে মনে হতেই পারে পরিকল্পনাকারী সিনেমা দেখেন খুব। মিল্কী হত্যা মামলার অন্যতম আসামী ছিলেন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। মিল্কী হত্যা মামলায় তিনি কারাগারেও ছিলেন। সেই টিপুকে গত বৃহস্পতিবার রাতে ফিল্মি স্টাইলে হত্যা করা হয়েছে। শাহজাহানপুর এলাকায় যানজটে আটকে থাকা মাইক্রোবাসে বসে ছিলেন জাহিদুল ইসলাম টিপু। হেলমেট ও মাস্ক পরা শুটার এসে একেবারে কাছ থেকে এলোপাতাড়ি গুলি করে তাকে।
বাংলাদেশে এখন রাজনীতি মানেই রাজা হওয়ার লড়াই। আর এই লড়াইয়ে জিততে যুদ্ধ হয় রাজায় রাজায়। আর প্রাণটা যায় প্রীতির মত উলুখাগড়ার। এই লেখা যখন লিখছি, তখন খবর পেলাম রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় রোববার ভোরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন আহমেদ মাহি বুলবুল নামে একজন চিকিৎসক। প্রীতি-বুলবুলরা উলুখাগড়ার মত, ঘাসের মত অপ্রয়োজনীয় এভাবেই প্রীতিরা, বুলবুলরা গুলিতে বা ছুরিতে প্রাণ দেবে। কোনো বিচার হবে না। দেড় মিনিটের ফিল্মি স্টাইলের অভিযানে টিপুর শরীরে অন্তত ১২টি বুলেট বিদ্ধ হয়। তারমানে খুনি একদম পেশাদার, কোনো ঝুঁকিই সে নেয়নি। সবার ধারণা ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। পুলিশ এরই মধ্যে মুখোশধারী ভাড়াটে খুনি মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে গ্রেপ্তার করেছে। মূল শুটার যেহেতু ধরা পড়েছে, পুলিশী তদন্তে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে কারা এ হত্যার পেছনে আছে। তবে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, টিপু হত্যাকাণ্ড সেই পুরোনো রাজনীতি, স্বার্থ, ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে লড়াইয়েরই ফল। যেমনটি ছিল মিল্কী হত্যাকাণ্ডও। ২০১৬ সালে খুন হয়েছিলেন যুবলীগ কর্মী রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোঁচা বাবু। আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তদন্তে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। তবে মিল্কী হত্যাকাণ্ড, বোঁচা বাবু হত্যাকাণ্ড টিপু হত্যাকাণ্ডে কোনো না কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে। একই রকম স্বার্থের সংঘাত সবখানে। এই যে খুনোখুনি, শেষ পর্যন্ত সবাই কিন্তু আওয়ামী লীগ। কেউ যুবলীগ, কেউবা ছাত্রলীগ। এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকলেও এই সময়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই বেশি মারা গেছেন। কখনো রাজনৈতিক, কখনো ব্যবসায়িক, কখনো নির্বাচনী দ্বন্দ্বে প্রাণ গেছে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, বঙ্গবন্ধুর আদর্শও তাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত স্বার্থটাই সবার আগে। টিপু ছিলেন মিল্কী হত্যা মামলার আসামী। আবার মিল্কীর ঘনিষ্ঠ বোঁচা বাবু হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন টিপু। কার সাথে কার স্বার্থ, কার সাথে কার বিরোধ; আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই চক্কর বোঝা বড় দায়। টিপু হত্যার পর গত কদিনে পত্রিকায় এতসব অনুমান ছাপা হয়েছে, অনেকগুলো পড়ে আমার মাথা রীতিমত গোলকধাঁধাঁয়।
মতিঝিল-শাহাজাহানপুর এলাকা যেন সরকারি দলের নেতাকর্মীদের জন্য সোনার খনি। এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ যার হাতে; ক্ষমতা, অর্থ, প্রভাব সব তার হাতে। ক্লাব এলাকা তো আছেই; আছে ফুটপাত, মার্কেট, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, স্কুলের ভর্তি বাণিজ্য- কাঁচা টাকার অঢেল উৎস। মিল্কীর মৃত্যুর পর যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট এবং খালিদ মাহমুদ ভুইয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল মতিঝিল-শাহজাহানপুর এলাকা। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে তারা সাম্রাজ্য হারালে জাহিদুল ইসলাম টিপু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে কারাগারে থেকেও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করছেন খালিদ মাহমুদ ভুইয়া। মানিক নামের এক প্রবাসী সন্ত্রাসীর নামও দেখলাম পত্রিকায়। নানামুখী প্রভাব আর স্বার্থের বলি হয়েছেন টিপু। শুরুতে সিনেমার কথা বলছিলাম। সিনেমায় দেখা যায়, একটি হত্যা আরেকটি হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করে। ১০ বছর, ২০ বছর পরেও নিহতের স্বজনরা বা ঘনিষ্ঠরা বদলা নেয়। এ কারণেই বলছিলাম, মিল্কী, বোঁচা বাবু, টিপু হত্যাকাণ্ডে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো যোগসূত্র আছে। কে জানে টিপু হত্যাকাণ্ড আবার নতুন কোনো হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করলো কিনা। যে কোনো মৃত্যুই বেদনাদায়ক। প্রতিটি মানুষের প্রাণই অমূল্য। একটি মানুষের মৃত্যুর বেদনা একটি পরিবার বয়ে বেড়ায় আজীবন। সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত জাহিদুল ইসলাম টিপুর পরিবার আছে, সন্তান আছে। তার মৃত্যু তার স্ত্রী-সন্তানদের জন্য বয়ে এনেছে অনন্ত বেদনা। তবু মিল্কী, বোঁচা বাবু, টিপুদের মৃত্যু আমাকে অতটা বেদনার্ত করে না। তারা তো জেনেবুঝেই এই জগতে পা রাখেন। এখানে অর্থ আর ক্ষমতা যেমন আছে, আছে মৃত্যুর ঝূঁকিও। হত্যার কয়েকদিন আগেই টিপুকে ফোন করে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। এখন জানা যাচ্ছে, মাসুম আগের দিনও টিপুকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। এই হুমকি, ঝুঁকির মধ্যেই টিপুদের বেঁচে থাকা। তাদের জীবন-মৃত্যুর মাঝে যেন সুতার ব্যবধান। একপক্ষ মিল্কীকে মারবে, আরেক পক্ষ বোঁচা বাবুকে মারবে, আবার কেউ প্রতিশোধ নিতে টিপুকে মারবে। এভাবেই চলছে, এভাবেই হয়তো চলবে।
তবে আমার আজকের লেখার সকল নিবেদন, সকল শোক, সকল বেদনা, সকল ভালোবাসা কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান জামাল প্রীতির জন্য। প্রীতি লড়াই করছিলেন একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে। মৃত্যুর সময় কোনো পদে না থাকলেও টিপু ব্যবসা-বাণিজ্য এলাকার নিয়ন্ত্রণ মিলিয়ে বেশ বিত্তশালী ছিলেন। টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর। স্বামীর জন্য বেদনা অনুভব করলেও সংসারের হাল ধরার সামর্থ্য তার আছে। কিন্তু পরিবারের স্বপ্নকে সাথে নিয়ে বিনা কারণে, বিনা দোষে মরে গেছে প্রীতি। এ মৃত্যুর কোনো সান্ত্বনা নেই। শান্তিবাগে প্রীতিদের তিনরুমের বাসার একরুম আবার সাবলেট দেয়া। দুই রুমের বাসায় বাবা-মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে ছিল প্রীতিদের সংসার। অর্থের অভাব থাকলেও শান্তির অভাব ছিল না তাতে। বাবার সাথে সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির চেষ্টা করছিল প্রীতি। চাকরি একটা পেয়েছিলেনও। পহেলা এপ্রিল প্রীতির নতুন চাকরিতে যোগ দেয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল গোটা পরিবার। বান্ধবীর বাসায় বেড়ানো শেষে নিজেদের বাসায় ফিরছিলেন প্রীতি। কিন্তু পথে মা ফোন করে বলেন, মামা আসবে বলে বাসায় জায়গার টানাটানি। তাই আরো একদিন যেন বান্ধবীর বাসায় বেড়িয়ে আসে। বান্ধবীর বাসায় ফিরতে গিয়েই রিকশায় যানজটে আটকা পড়েন প্রীতি। আর তার রিকশাটি ছিল টিপুর মাইক্রোবাসের পাশে। অতি সতর্ক আততায়ী টিপুর মৃত্যু নিশ্চিত করতে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ে। টিপুর শরীরে ১২টি, তার ড্রাইভারের একটি এবং আরেকটি বুলেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় প্রীতির হৃদয়, একটি পরিবারের স্বপ্ন। সবাই তখন টিপুকে নিয়ে ব্যস্ত, কেউ বুঝতেই পারেননি প্রীতিও গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে রাস্তায়। টিপু, রাজনীতি, ব্যবসা, স্বার্থ, টেন্ডারবাজি- কোনোকিছুর সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকা প্রীতি মরে গেল টুপ করে। টিপু হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী বাদি হয়ে মামলা করেছেন। কিন্তু প্রীতির বাবা-মা বিচার চান না, মামলাও করেননি। তারা জানেন বিচার পাবেন না, মামলা করে লাভ কী? বরং মামলা করতে গেলে হয়রানি বাড়বে, ঝুঁকির মুখে পড়বে পুরো পরিবার। তারা আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছেন। এই যে সন্তানের মৃত্যুর পরও বাবা-মার বিচার না চাওয়া, এটা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ঙ্কর ব্যর্থতা। সাধারণ মানুষের আর প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আস্থা নেই। তারা জানেন, চাইলেও যে বিচার পাবেন না, সে বিচার চেয়ে লাভ কী? কার কাছে বিচার চাইবেন। বাংলাদেশে এখন রাজনীতি মানেই রাজা হওয়ার লড়াই। আর এই লড়াইয়ে জিততে যুদ্ধ হয় রাজায় রাজায়। আর প্রাণটা যায় প্রীতির মত উলুখাগড়ার। এই লেখা যখন লিখছি, তখন খবর পেলাম রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় রোববার ভোরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন আহমেদ মাহি বুলবুল নামে একজন চিকিৎসক। প্রীতি-বুলবুলরা উলুখাগড়ার মত, ঘাসের মত অপ্রয়োজনীয় এভাবেই প্রীতিরা, বুলবুলরা গুলিতে বা ছুরিতে প্রাণ দেবে। কোনো বিচার হবে না।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।