খারকিভ, মারিউপোলে ভয়াবহ যুদ্ধ, ১০ হাসপাতাল ধ্বংস, অন্যত্র ভুতুড়ে নগরী

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ খারকিভ এবং মারিউপোলের চারপাশে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। এরই মধ্যে কমপক্ষে ১০টি হাসপাতাল পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। রাশিয়ার নৌবাহিনী ওডেসায় গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে। এই শহরটিকে কৃষ্ণসাগর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় তারা। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, আগ্রাসনে ইউক্রেনের কমপক্ষে ১১৭টি শিশু নিহত হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি ইউক্রেনে রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্র বা উভয়টিই ব্যবহার করতে পারেন বলে সতর্ক করেছেন বাইডেন। ইউক্রেনের জনবসতি এখন ভুতুড়ে নগরী।
মানুষ নেই। নিস্তব্ধ। সুনশান। কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন দালানকোঠা। দেখে মনে হবে কয়েক শতাব্দী আগে সেখানে জনবসতি ছিল। তবে অনেক স্থানে এখনো রাশিয়ার সেনাদের রুখে দিচ্ছে ইউক্রেনের দেশপ্রেমিক সেনারা। তাদের কাছে পর্যুদস্ত হচ্ছে রুশ সেনারা। রাস্তায় রাস্তায় দেখা যায় রুশ সেনাদের ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে দিয়েছে ইউক্রেনের সেনারা। এসব দৃশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। হিরোশিমা-নাগাসাকির প্রায় একই রকম অবস্থা হয়েছিল। তবে পার্থক্য এই যে, হিরোশিমা-নাগাসাকিতে ফেলা হয়েছিল হাইড্রোজেন বোমা। আর ইউক্রেনে ফেলা হচ্ছে সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। তারা নিজেরা নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছে, ইউক্রেনে কমপক্ষে দুটি সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এর মধ্যে সোমবার সতর্ক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনে জীবাণু অস্ত্রের একটি ল্যাবরেটরি আবিষ্কারের ভুয়া দাবি করেছে রাশিয়া। তাদের অভিযোগ রাজধানী কিয়েভে ওই ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত ছিল। বাইডেন বলেন, এই ভুয়া যুক্তিই ইঙ্গিত দেয় যে, পুতিন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এবং তিনি ভুয়া ফ্ল্যাগ অপারেশন চালাতে প্রস্তুত। এ জন্য হয়তো ইউক্রেনকে তিনি দায়ী করবেন।
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-ইভস লা দ্রিয়ান বলেছেন, ইউক্রেনে যদি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাহলে এর জন্য রাশিয়াকে দায়ী করা হবে। ওদিকে ইউক্রেন ইস্যুতে ভারতের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন জো বাইডেন। তিনি একে ভারতের ‘কিছুটা নড়বড়ে’ অবস্থান বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখার লক্ষ্য স্থির করেছে নয়াদিল্লি। তবে এ ইস্যুতে জাপান কট্টরভাবে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। একই রকম অবস্থান নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের মধ্যে কোয়াড্রিল্যাটারেল স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ প্রসঙ্গে এসব কথা বলেন বাইডেন। এর কয়েকদিন আগে ভারতে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার বলেন যে, নয়াদিল্লির নিরপেক্ষ অবস্থান মেনে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। এমন মন্তব্যের পর বাইডেন ওই কথা বলেছেন। ওদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক এজেন্সি ইউএনএইচসিআর বলেছে, ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পর থেকে কমপক্ষে ৩৫ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে গেছেন। গত এক মাসেই এসব মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী দেশগুলোতে। কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছেন পোল্যান্ডে। ইউক্রেনে যেভাবে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া তাতে সেখানে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের খাবার নেই। বিদ্যুৎ নেই। পানি নেই। যারা যুদ্ধকবলিত শহরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের অবস্থা বর্ণনার অযোগ্য। এর ওপর জো বাইডেনের হুঁশিয়ারিতে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। জো বাইডেন সোমবার রাতে বলেছেন, ভ্লাদিমির পুতিন একপেশে হয়ে পড়েছেন। তিনি ইউক্রেনে জীবাণু অস্ত্র বা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। বাইডেন বলেন, পরিষ্কার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যে, পুতিন উভয় অস্ত্রই ব্যবহার করতে পারেন। এর আগে তিনি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারও করেছেন। তবে সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়ে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। জো বাইডেন আরও বলেন, পুতিনের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে। এখন তিনি নতুন এক ভুয়া অভিযোগ দাঁড় করছেন। বলছেন, ইউরোপে মার্কিনিদের কাছে জীবাণু অস্ত্র এবং রাসায়নিক অস্ত্র আছে। তার এই অভিযোগ একেবারে অসত্য। এ বিষয়ে আপনাদেরকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমি। রাশিয়ার অভিযোগ, তারা ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘বায়ো-ল্যাব’ আবিষ্কার করেছে। এটাকে ব্যবহার করে তারা ওই দেশে মিথ্যা ফ্ল্যাগ অপারেশন চালানোর প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে পারে।
যুদ্ধে টিকে থাকার শেষ প্রান্তে ইউক্রেন
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়ার আগ্রাসনে যুদ্ধে টিকে থাকার প্রান্তঃসীমায় পৌঁছে গেছে তার দেশ। ইতালির পার্লামেন্টে দেয়া ভিডিও লিঙ্কের ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে ভাষণ দিয়ে বিরল সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। এদিন ইতালির পার্লামেন্ট সদস্যরাও দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানান। এর আগে বৃটেন, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলের পার্লামেন্টে ভাষণ দেন জেলেনস্কি। তার বেশির ভাগেই পার্লামেন্ট সদস্যরা দাঁড়িয়ে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। ইতালিয়ান এমপিদের উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি সতর্ক করেন সবাইকে। বলেন, বাকি ইউরোপকে ভেঙে দিতে চায় মস্কো। রাশিয়ান সেনাদের জন্য ইউরোপে প্রবেশের জন্য ইউক্রেন হলো প্রবেশদ্বার। তারা ইউরোপকে ভেঙে দিতে চায়। এই বর্বরতাকে সফল হতে দেয়া উচিত নয়। এ সময় তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আহ্বান জানান। জবাবে ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি বলেন, ইউক্রেনকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে দেখতে চায় ইতালি। রাশিয়ার আগ্রাসনের জবাবে ইউক্রেন বীরোচিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। রাশিয়া সরকারের একগুঁয়েমির সঙ্গে মর্যাদাবান ইউক্রেনের মানুষের সংঘর্ষ হচ্ছে। মস্কোর সম্প্রসারণের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। ওদিকে বুধবার ফ্রান্সের পার্লামেন্টে বক্তব্য দেয়ার কথা রয়েছে জেলেনস্কির।
১১৭ শিশুকে হত্যা
ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর কমপক্ষে ১১৭টি শিশুকে হত্যা করেছে রাশিয়ানরা। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৫৫ জন। এ তথ্য দিয়েছে ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেলের অফিস। এতে বলা হয়, বেশি শিশু মারা গেছে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের ভেতরে ও বাইরে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভে। কিয়েভে মারা গেছে ৫৮টি শিশু। খারকিভে ৪০। দক্ষিণের মারিউপোল শহরে উদ্ধারকারী বাসে করে শিশুদের সরিয়ে নেয়ার সময় তাতে রাশিয়া বোমা হামলা করেছে। কমপক্ষে ৫৪৮ বার স্কুল ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আঘাত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭২টি প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
৬২ হাসপাতালে হামলা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, প্রায় চার সপ্তাহ আগে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ইউক্রেনে আলাদাভাবে কমপক্ষে ৬২টি স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক স্থাপনায় হামলা করেছে রাশিয়া। আরও বলা হয়েছে, এসব হামলায় নিহত হয়েছেন ১৫ জন। কমপক্ষে ৩৭ জন আহত হয়েছেন। পোল্যান্ডে অবস্থানরত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, দ্রুততার সঙ্গে যেসব বিষয় অনুধাবন করা হয়েছে তাতে প্রায় ৫ লাখ শরণার্থী, যারা পোল্যান্ডে গিয়েছেন, তারা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। প্রথমত তাদের মানসিক বৈকল্য দেখা দিয়েছে। সীমান্ত এলাকায় যেসব শিশু ও মায়েরা পৌঁছাচ্ছেন তাদের প্রাণশক্তি ফুরিয়ে গেছে। তারা পানিশূন্যতায় ভুগছেন। কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা সুবিধা ছাড়া বহু প্রবীণ মানুষ কয়েকদিন সফর শেষে সীমান্তে পৌঁছাচ্ছেন। তাদের অনেকের আছে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ।