যশোরের রুট দিয়ে থামছেই না ভারতে সোনা পাচার

0

সুন্দর সাহা ॥ প্রায়শই যশোরের বিভিন্ন স্থান থেকে সোনা ধরা পড়ার খবর গণ মাধ্যমে উঠে আসে। মাঝে মাঝে এত সোনা ধরা পড়ে বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জব্দ করে যে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কোথা থেকে আসে এসব সোনা আর কারা জড়িত? তারা কেনো ধরা পড়ে না। গত ২৭ মাসে যশোর ৪৯ ব্যাটালিয়ান, খুলনা ২১ ব্যাটালিয়ান এবং সাতক্ষীরা ৩৩ ব্যাটালিয়ানের অভিযানে আটক হয়েছে ৮৮ কেজি সোনা। সীমান্তের মানুষের দাবি, যে পরিমাণ সোনা আটক হয় পাচার হয় তার একশ’ গুণেরও বেশি। অভিযোগ রয়েছে, সোনা পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে পরিণত হয়েছে যশোরের বিভিন্ন সীমান্তের অবৈধ পকেট ঘাটগুলো। ভারতে সোনর চাহিদা এবং দাম বেশি হওয়ায় এ সীমান্ত পথে স্বর্ণ পাচার করছে আন্তর্জাতিক ও দেশী পাচারকারীরা। সীমান্তে সোনা পাচারে সবার উপরে রয়েছে শার্শা উপজেলার দু’ডজন সিন্ডিকেট। যার মধ্যে সব চেয়ে বড় সিন্ডিকেটের মালিক গোল্ড রমজান। এছাড়া, বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন পরিচয়ের প্রতিনিধিদের সব সোনার হিস্যা দিতে হয় অবৈধ ঘাট মালিকদের। যার প্রধান হোতা হচ্ছে এই বহুরুপি এই রমজানসহ আন্তর্জাতিক সোনা পাচারের স¤্রাট নাসির, ভয়ংকর দেব কুমার।
সীমান্তের সূত্রগুলো বলছে, প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ সোনা যশোরের বিভিন্ন ঘাট দিয়ে ভারতে পাচার হয়। শার্শা উপজেলায় যে সব সিন্ডিকেট আছে তাদের অধিকাংশের মূল মালিক হচ্ছে সোনা পাচার চক্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূল হোতা আলোচিত ফেন্সি ডিলার ও সোনা পাচারের গডফাদার রমজান। রমজানের পরই যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছে রমজানের প্রধান শিষ্য আন্তর্জাতিক সোনা পাচারের স¤্রাট নাসির উদ্দীন, ভয়ংকর দেব কুমার, কিলার বাদশাসহ বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিন পাচার হয় অধিকাংশ সোনা। এছাড়াও সাদীপুর, দৌলতপুর এবং বড়আঁচড়া রেল লাইন দিয়েও বিপুল পরিমাণ সোনা পাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযান চললেও সোনা পাচারের এসব সিন্ডিকেটের অঘোষিত মালিকরা রয়েছে বহাল তবিয়তে। এই চক্রের খুঁটির জোর বেশি থাকার কারণে এদের টিকিটিও কেউ স্পর্শ করছে না বলে জোর মতামত রয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হওয়ার পাশাপাশি ঘাটে-ঘাটে বিপুল পরিমাণ হিস্যা দিতে পারার কারণে এবং সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় প্রতিদিন পাচার হচ্ছে কোটি-কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ সোনার বার। পাচার হওয়া সোনার খুব কমই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তবে যখন ধরা পড়ে তখন কেজি কেজিই ধরা পড়ে। কেজি কেজি সোনা একবার ধরা পড়ার পর এ কথা আলোচনায় আাসে যে এতটা ধরা পড়লে পাচার হয় কত? বিপুল পরিমাণ সোনা পাচারের কথা স্বীকার করেছেন বিজিবি ৪৯ ব্যটালিয়নের সিও। তার মতে তাদের তৎপরতা রয়েছে, ধরাও হচ্ছে তবে প্রতিনিয়তই পাচারকারীরাও রুট পাল্টিয়ে নতুন রুটে নতুনভাবে পাচার করে। অভিযোগ রয়েছে বিজিবি সোন পাচার ধরার ব্যপারে যতটা উদগ্রীব পুলিশের তৎপরাতা ততটা চোখে পড়ে না। এ নিয়ে নানান মহেলে নানা গুঞ্জন রয়েছে। অনেকের অভিযোগ পুলিশ দেখেও দেখে না অথবা আরো কিছু বলে। অবশ্য পুলিশ সেভাবে দায় না নিলেও তাদের দাবি, সোনা ১০ বার ধরলে প্রচারিত হয় ২০টি বার ধরে ১০টি হজম করে বাদবাকি উদ্ধার দেখিয়েছে। এ কথার সত্যতাও কিছুটা মানতে রাজি সূত্রগুলো। সাধারণত যা উদ্ধার হয় প্রচার হয় আরো বেশি। পুলিশের ক্ষেত্রে এই প্রচার বেশি পায় বিজিবির ক্ষেত্রে ততটা পায়না।
যশোর ব্যাটালিয়ান (৪৯বিজিবি)-র সিও লে. কর্ণেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে জানান, “২০২০ সালে তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মোট ৪১ কেজি ৭২২ গ্রাম সোনা আটক করা হয়েছে। যার মূল্য ২৭ কোটি ৯৩ লাখ ৮২ হাজার ৩৪০ টাকা। ২০২১ সালে উদ্ধার হয় ১৩ কেজি ১৪৩ গ্রাম সোনার বার, যার মূল্য ৯ কোটি ৫ লাাখ ৬ হাজার টাকা। ২০২২ সালে এ পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে এক কেজি ১৬৫ গ্রাম সোনার বার, যার মূল্য ৮২ লাখ টাকা।” খুলনা ব্যাটালিয়ান (২১ বিজিবি)-র সিও লে. কর্ণেল মজ্ঞুর এলাহির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে জানান, “২০২০ সালে তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মোট ১ কেজি ৫২৩ গ্রাম সোনা করা হয়েছে। যার মূল্য ৯১ লাখ ৪০ হাজার ৩৯২১ টাকা, ২০২১ সালে উদ্ধার হয় ৫ কেজি ৫৪২ গ্রাম সোনা আটক করা সম্ভব হয়েছে। যার মূল্য ৩ কোটি ৩৩ লাখ, ৪৩ হাজার ৪৮১ টাকা, ২০২২ সালের এ পর্যন্ত ৩ কেজি ৮৮৯ গ্রাম সোনা আটক করা সম্ভব হয়েছে। যার মূল্য ২ কোটি ৪৬ লাখ ৮১হাজার ৪৭৫ টাকা।” সাতক্ষীরা ব্যাটালিয়ান (৩৩ বিজিবি)-র সিও লে. কর্ণেল মোহাম্মদ আল মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে জানান, “২০২০ সালে তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মোট ১৬ কেজি ৪০৯ গ্রাম সোনা আটক করেছেন। যার মূল্য ৯ কোটি ২৭ লাখ ৫৮ হাজার ৭১১ টাকা, ২০২১ সালে উদ্ধার হয় ৪ কেজি ৫৬১ গ্রাম সোনার বার। যার মূল্য ৩ কোটি ৭৬ হাজার টাকা, ২০২২ সালে এ পর্যন্ত কোন সোনা উদ্ধার হয়নি।”
সূত্রের দাবি উদ্ধার হওয়া এসব চালান পাচারকারীরাই ধরিয়ে দেয়। সে সুযোগে সীমান্ত নিরাপদ রেখে পাচার করে একেক চালানে ১-২ মণ যাতে ধরিয়ে দেয়া সোনার দামও লাভ যুক্ত করে উসুল করা যায়। সীমান্তের বিভিন্ন সূত্র বিভিন্ন সময়ে এই পাচারকারী হিসেবে যাদের নাম সামনে এনেছে এবং যাদের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে সেগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে। সূত্র মতে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে আলোচিত নাসির, চিটার রমজান, দেবকুমার এবং রঘুনাথপুরের ফেন্সি স¤্রাট বাদশা ছাড়াও পুটখালীর জসিম, মহব্বত, ঘিবার শাহজাহান, পুটখালীর ইব্রাহিম, আলমগীর, খাড়া মুনসুর, সিরাজুল পন্ডিত, রায়হান, সাদীপুরের আলোচিত কামাল, ছোট-আঁচড়ার মানি, হায়দার, আশা ও জাকির, পুটখালীর রেজা ও জিয়া সিন্ডিকেটগুলো মাধ্যমেও অস্ত্র-মাদকের পাশাপাশি সোনা পাচারের সাথে জড়িত। রঘুনাথপুরের আখের, গাতীপাড়ার করিম ও শহিদুল, ছোট আঁচড়ার বকুল, পুটখালীর আরিফ, ইকবাল ও আলমগীর, কাঠুরিয়ার খোকা ও ছোট-আচড়ার খায়ের, বড় আঁচড়ার জসিম ও কামাল, পুটখালীর মিলন ও জামাল, দুর্গাপুর রোডের জিয়া এবং ধান্যখোলার বাচ্চুর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ সোনা ভারতে পাচার হচ্ছে। তবে যশোরের শার্শা, বেনাপোল ও চৌগাছার সবগুলি সীমান্ত দিয়ে যত সোনাযায়, পুটখালী সীমান্তের ৭টি পকেট ঘাট দিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি সোনা ভারতে পাচার করা হয় বলে সীমান্তের সূত্রগুলো জানায়। আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আবার কখনও কখনও তাদের ম্যানেজ করে চলে সোনা পাচারের রমরমা ব্যবসা।
সূত্রগুলো আরও জানায়, ঢাকা থেকে সিন্ডিকেটের ক্যারিংম্যনেরা সোনার বার বিভিন্নভাবে নিয়ে আসে যশোরের বিভিন্ন সীমান্তের আলোচিত সব পয়েন্টে। পরিবহন কাউন্টার অথবা তাদের নির্ধারিত স্থানে স্বর্ণের চালানটি হাত বদল হয়ে চলে যায় স্থানীয় এজেন্টের হাতে। এরপর স্থানীয় এজেন্টরা সেই স্বর্ণের চালান নিয়ে যায় পুটখালী, গাতীপাড়া, বড়আঁচড়া, রঘুনাথপুর, সাদীপুর, শিকারপুর, দৌলতপুর, ঘিবা সীমান্তের নির্ধারিত কোনও বাড়িতে। সেখান থেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় ডিলার অপু, বস্ গৌতম, ছোট গৌতম, পিন্টু, বরুণ, ডাকুসহ বিভিন্ন সিন্ডিকেটের হাতে সোনার চালান পৌঁছে দেওয়া হয়। সূত্র বলছে, বিভিন্ন সময় স্বর্ণের এসব চালান ধরা পড়ায় পাচারকারীরা কৌশল বদল করে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ভারতে সোনার দাম বেশী হওয়ায় এ সীমান্ত পথে পাচার করছে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানীরা। ফলে এ সুযোগে চোরাচালানীরা প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ সোনা পাচার অব্যাহত রেখেছে। তবে রাঘব-বোয়ালরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ারবাইরে। সীমান্তের সূত্রগুলোর দাবি, এসব সোনার অধিকাংশের মালিক রমজান, নাসির, দেব, বাদশা, শাহজাহান, জসিম, মানি, সিরাজুল পন্ডিত, রায়হান এবং মহব্বতসহ সীমান্তের ছোট-বড় সিন্ডিকেটগুলো।
এ ব্যাপারে ৪৯ বিজিবি যশোরের সিও লে. কর্ণেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী জানান, বিজিবি সীমান্ত রক্ষায় সব সময় চেষ্টা করছে-করছে পাচার রোধ। তারপরও নিরঙ্কুশ ও নিশ্চিত করা যায়নি। করোনার সময় বেশ কিছুদিন সীমান্ত বন্ধ থাকায় চোরাচালান কম ছিল। তাছাড়া ধরা পড়ার পর পাচারকারীরা কৌশল বদলায়, নতুন রুট তৈরি করে। ব্যবসায় তাদের লাভ বেশি তাই ঝুঁকিও তারা নেয়। তারপরও বিজিবি কাজ করছে। তিনি আশা করেন এক সময় চোরাচালান বন্ধ হবে। কোনো গড ফাদার ধরা পড়ে না বা আলোচিত হোতারা বাইরে থাকে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অনেক সময় পরিত্যাক্ত অবস্থায় সোনর বার পাওয়া যায়। বিজিবির অভিযান বুঝতে পেরে পালিয়ে যায় মাল ফেলে। যারা ধরা পড়ে তারা বাহক মাত্র। তারা নানা কৌশলে হাত বদল করে। একেটা গ্রুপ একেক অংশে দায়িত্ব পালন করে, যার কাছ থেকে তারা গ্রহণ করে তাদের যেমন তারা চেনে না তেমনি যার কাছে দেয় তাদেরকেও চেনেনা। কিছু সাংকেতিক, কিছু সিম্বল তারা ব্যবহার করে একে অপরের কাছে বদল করে। একারণে যেমন শিকড়ের গোড়ায় যাওয়া যায় না তেমনি আটক ব্যক্তিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে থানায় দিতে হয় এ কারণে তাদের ব্যপক জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ নেই বলেও তিনি জানান। তার মতে পুলিশ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ব্যপক রিম্যান্ডের মাধ্যমে আরো গভীরে যেতে পারে।