আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ: জেন্ডার বৈষম্য প্রকট কর্মে আচরণে ও কথায়

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সেøাগান হচ্ছে “ টেকসই আগামীর জন্য জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য”। এ কথা তো অনস্বীকার্য, দেশের সর্বত্র নারীর গুরুত্ব আজ স্বীকৃত। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন অনেকটাই বেড়েছে। সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশের যে বিস্ময়কর উত্থান, তার নেপথ্যে নারীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সূচকে যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, তাতেও নারীর অবদান রয়েছে। তার পরও স্বীকার করতে হবে, বৈষম্য একেবারে দূর করা যায়নি। শুধু তা-ই নয়, সমাজে অনেক ক্ষেত্রে নারীকে এখনো অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। নিরাপত্তাহীনতা এখনো নারীর এগিয়ে চলার পথে এক বড় বাধা। পথে-ঘাটে চলাচলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ নারী নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হন। নারীর প্রতি অবমাননাকর আচরণ বন্ধে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ইতিবাচক ব্যবহারও নারীর প্রতি আচরণে পরিবর্তন আনতে পারে।
এক জরিপে বলা হচ্ছে, দেশে মোট তরুণীর ৬৫.৫৮ শতাংশই যৌন হয়রানির শিকার হয়। এর মধ্যে ৩৫.৪৯ শতাংশ বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পেয়েছে, ২৯.৬২ শতাংশ আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী ও ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২.২৬ শতাংশ। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত শনিবার বেলা ১১টায় এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে সংস্থাটি। জরিপে অংশ নেন এক হাজার ১৪ জন শিক্ষিত তরুণী। তাদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর; অবিবাহিত ৮৮.১৭ শতাংশ ও বিবাহিতের সংখ্যা ১০.৯৫ শতাংশ এবং বাকিরা আর সংসার করছেন না। বৈষম্য, লাঞ্ছনা, যৌন হয়রানি, সমাজ ও পরিবারে প্রতিবন্ধকতা, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসহ প্রভৃতি বিষয়ে তরুণীদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন এ পরিসংখ্যান। আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪৫.২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন। বাস বা বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির মতো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ৮৪.১০ শতাংশ তরুণী। রেল বা রেল স্টেশনে ৪.৫৮ শতাংশ এবং রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ১.৫৩ শতাংশ তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যৌন হয়রানির মধ্যে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হয় ৬৪.৯২ শতাংশ তরুণী। এমনকি ২০.০৪ শতাংশ তরুণী কুদৃষ্টি এবং অনুসরণের শিকার হয়েছেন।
তরুণীরা সবচেয়ে বেশি এ ধরনের নিপীড়নের শিকার হন একাকী চলার সময়ে, যা ৭৫.৬০ শতাংশ। তবে ২১.৫৭ শতাংশ মা, বোন, বান্ধবী বা অন্য নারী সঙ্গী থাকা অবস্থায় এবং ২.৮৩ শতাংশ বাবা, স্বামী, ভাই বা অন্য পুরুষ সঙ্গী থাকা অবস্থায় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ৩৮.৮৬ শতাংশ তরুণী শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। তার মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের দ্বারা ৩৫.২৮ শতাংশ যৌন নিগ্রহমূলক আচরণের শিকার হন। শৈশবে অপরিচিত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা ভুক্তভোগী হন ২৮.১৭ শতাংশ। এ ছাড়া ১৬.৫০ শতাংশ প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এমন আচরণের শিকার হন। শৈশবের এরূপ ঘটনা ২৮.৪৩ শতাংশের মনে সবার প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং ২৮.১৭ শতাংশের ভেতর পুরুষ বিদ্বেষী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া ১৫.৭৪ শতাংশ একা থাকতে ভয় পান। ১.৭৮ শতাংশ নারী উল্লেখিত সব ধরনের ট্রমার ভেতর দিয়ে গেছেন। ৪৩.৮৯ শতাংশ তরুণী অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন বলে জানান। এর মধ্যে অবান্তর ও কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়ে এবং মন্তব্য করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১.১২ শতাংশকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন ১০.৩৪ শতাংশ। ৯.৮৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে দুর্ভোগ পোহান বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া অযাচিত আইডি স্টাকিংয়ের শিকার হন ৫.১৭ শতাংশ। জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে তরুণীরা মতামতের ক্ষেত্রে তার পরিবারে গুরুত্ব পায় কিনা, সেই প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তর দেন অংশগ্রহণকারীদের ২২.২৯ শতাংশ। শুধুমাত্র নারী হওয়ার দরুন মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয় ৪৬.২৫ শতাংশকে। সমীক্ষার ফলাফলে জানা যায়, পারিবারিক টানাপোড়েন তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক প্রভাব ফেলে, যা ৩১.৮৫ শতাংশ। আর্থিক অসচ্ছলতা অংশগ্রহণকারীদের ২৪.৪৬ শতাংশের মনে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। বেকারত্বের কারণে ১৪.৭৯ শতাংশ মানসিকভাবে বিপর্যয়ের শিকার হন। ১৪.৪০ শতাংশ সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার মাধ্যমে ও ২.৩৭ শতাংশ তরুণী যৌন নিপীড়নের কারণে মানসিকভাবে প্রভাবিত হন।
সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, পারিবারিক টানাপোড়েনের পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, পারিবারিক অসচ্ছলতা ৩০.৭২ শতাংশ তরুণীদের মনে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পারিবারিক কলহ ২৭.৩২ শতাংশের মনে বিরূপ প্রভাব বিস্তর করে। সেই সঙ্গে পরিবার থেকে অযাচিত চাপের কারণে মানসিকভাবে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন ২৩.৯২ শতাংশ নারী। পরিসংখ্যানের তথ্য ও উপাত্ত অনুযায়ী, ৬৯.৯২ শতাংশ তরুণী শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৭.২৪ শতাংশ তরুণী জানিয়েছেন, শরীরের আকৃতি ,গঠন এবং অবয়ব নিয়ে নিজেদের আত্মীয়রাই কথায় ও ইঙ্গিতে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। বন্ধুবান্ধবের কাছে বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ শতাংশ। এমনকি পরিবার থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনেছেন বলে জানিয়েছেন ১৪.২৫ শতাংশ। পথচারীর মাধ্যমে শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে ১১.৮৫ শতাংশ তরুণীর। ওজনের কারণে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হতে হয় বলে ৩৯.৪৯ শতাংশ তরুণী মনে করেন। গায়ের রঙের কারণেও ৩৬.৯৫ শতাংশ তরণী এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। এ ছাড়া উচ্চতা, মুখাবয়বের গঠন ও দাগ, কণ্ঠস্বর প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তরুণীরা বিরূপ মন্তব্য শুনে থাকেন বলে জানিয়েছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণীদের মধ্য থেকে ২৩.৭৭ শতাংশ তরুণী নিজেদের অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হন।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক—সব সূচকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে এখনো এমন অনেক পরিবার আছে, যেখানে নারী উপেক্ষিত। অনেক চেষ্টার পরও সামাজিকভাবে নারীর অবস্থান সেভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। অথচ একটু পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, এ দেশে ডাকসুর ভিপি ছিলেন একজন নারী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তো বটেই, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও বাঙালি নারী পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন, শহীদ হয়েছেন। বাংলাদেশের একজন নারী আন্তর্জাতিক দাবায় গ্রান্ড মাস্টার খেতাব পেয়েছেন। এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন বাংলাদেশের নারী। রাজনীতি থেকে প্রশাসন, সব ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে। এর পরও নারী উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। বেতন বৈষম্য থেকে নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আর এসব কারণেই এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্যটি বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের আহবান করলে এরপর থেকে সারা বিশ্বব্যাপী দিনটি পালিত হয়ে আসছে।