নারীদের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে

0

সংবাদপত্রের পাতা আর টিভির পর্দায় চোখ রাখলেই যে ভয়াবহ খবর চোখের সামনে প্রতিদিন ভেসে ওঠে তা হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা। পরিবার থেকে কর্মস্থল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, সর্বত্র একই অবস্থা। আত্মহত্যা, খুন, ধর্ষণ, নির্মম, নির্যাতন, পরকীয়ায় পলায়ন, বেওয়ারিশ লাশের খবরে নারীর অবস্থা পরিস্কার। বিশ্বায়নের এই সময়ে বাংলাদেশের নারীদের এ অবস্থা যতটা বেমানান তার চেয়ে বেশি উদ্বেগের। সরকারের পক্ষ থেকে নার্রী জাগরণ বা উন্নয়নের যে খবর প্রতিদিন দেয়া হয় বাস্তবতাকে তা প্রশ্নবিদ্ধ করে। মাঝে মাঝে নিরপেক্ষ কিছু জরিপ সে প্রশ্ন অনেক বড় করে। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বেসরকারি সংস্থার সাম্প্রতিক সময়ের জরিপে যে তথ্য দিচ্ছে তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক।
জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের ৬৯.৯২ শতাংশ তরুণী দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। জরিপ অনুযায়ী প্রায় ৩৯ শতাংশ তরুণী শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। প্রায় ৪৪ শতাংশ তরুণী অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন ৬৪.৯২ শতাংশ নারী। ঘরেও মানসিক সমস্যায় পড়েন নারীরা। ২২.২৯ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তাঁদের মতামতকে পরিবারে মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু নারী হওয়ার কারণে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয় ৪৬.২৫ শতাংশকে।
আমরা জানি, দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণও আশাব্যঞ্জক। বর্তমান ও সাবেক সরকারপ্রধান, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার নারী। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে নারীদের জয়জয়কার। সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাবসহ সকল বাহিনীতে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। সাংবাদিকতায়ও পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে নারী। শিক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভালো করছে। সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের নারী জাগরণ প্রশংসিত। আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পাচ্ছে। এর পরও ফাঁক থেকে যাচ্ছে। পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সমাজের পরিচয় যেন পাল্টে যাচ্ছে। সমাজ থেকে মানবিক মূল্যবোধ উধাও। অবক্ষয় চরমে। নৈতিকতা নির্বাসিতপ্রায়। আগের মতো নেই সামাজিক অনুশাসনও। পরিবারেও স্বস্তিতে নেই। অবিশ্বাস, ভুল বুঝাবুঝি, নির্যাতনে আত্মহত্যা বাড়ছে প্রতিদিনই। এটা ধর্মীয় গোড়ামী নাকি নারীদের বহুমুখি পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তা আসলে খুঁজে দেখা দরকার। খুঁজতে হবে। কেন বাড়ল সামাজিক অবক্ষয়, ভুল রাজনৈতিক মূল্যবাধই কি এর কারণ? নাকি আরো অনেকর্ কারণ রয়েছে নেপথ্যে। নারীবান্ধব সমাজ নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা কি আশাব্যঞ্জক নাকি সেখানেও গলদ রয়েছে ?
আমরা প্রত্যাশা করি, দিন দিন সমাজ এগিয়ে যাবে আলোর দিকে, কিন্তু আমরা যাচ্ছি অন্ধকারের দিকে। সমাজ এভাবে নারীর প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে কেন? কেন নারীকে আজকের দিনে এসেও প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক ধারণার প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতা কি এর জন্য দায়ী? নারীর প্রতি নিগ্রহের বিরুদ্ধে আমরা কেন কঠোর অবস্থানে যেতে পারছি না? নিগ্রহকারীরা কি রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে? সাম্প্রতিক কিছু আলোচিত হত্যাকান্ডে অভিযুক্তদের রক্ষা পাওয়ায় এ প্রশ্ন বড় হয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
এভাবে আর কত দিন? কবে অবসান হবে এই বর্বরতার? কবে আমাদের সমাজে নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে এবং পাবে যোগ্য সম্মান? আমরা সরকারকে বলবো, শুধু পরিসংখ্যান আর বক্তব্য নয়। নারীর জীবনমান ও নিরাপত্তার উন্নয়নে কাজ করুন। নারীদের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করুন।