বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে রাশিয়া

0

বিশেষ সংবাদদাতা॥ ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে বিশ্বায়নের এই পৃথিবীতে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে রাশিয়া। এই সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন খাত থেকে ছিটকে পড়েছে দেশটি। খর্ব হয়েছে বৈশ্বিক ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড চালানোর সক্ষমতা। বড় আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দেশটির অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে। ইউরোপের আকাশে নিষিদ্ধ দেশটির ফ্লাইট ও উড়োজাহাজ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্যে ভদকা আর পছন্দের তালিকায় নেই। এছাড়া নিরপেক্ষতার জন্য দীর্ঘদিনের খ্যাতি অর্জন করা সুইজারল্যান্ডও সতর্কভাবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। মাত্র তিন দিনের মাথায় রাশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে অচ্ছুৎ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এর মূল কারণ ইউক্রেনে দেশটির আক্রমণ এবং রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিনের বন্ধুর সংখ্যা কমছে তো কমছেই। বড় বিষয় হলো, মস্কোর বিরুদ্ধে এতদিক থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে যে এটিকে শুধু তাৎপর্যপূর্ণ বলাই যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় ওয়াকআউট করেন ৪০ দেশের প্রতিনিধিজাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় ওয়াকআউট করেন ৪০ দেশের প্রতিনিধি মাসকালেস্টার কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রিউ লাথাম। তিনি বলেন, খুব বড় কিছু ঘটেছে। তা না হলে তিন বা চার দিন আগেও যা কেউ কল্পনা করতে পারেনি, সেটাই ঘটছে। এটি পর্যবেক্ষণ সত্যিই অবাক করার মতো। মাত্র তিন দিনে বজ্রগতির মতো একের পর এক বড় বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা, জোটের পদক্ষেপ এবং তাদের ঘিরে থাকা সংস্থা ও ব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেছে। সব মিলিয়ে বিভিন্নভাবে তারা বিশ্বের অন্যতম বড় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। যা পেছনে ফেলেছে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে। ইউরোপীয় দেশগুলো এই ইস্যুতে একাট্টা হয়ে তাদের আকাশসীমায় রুশ বিমান নিষিদ্ধ করেছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা সুইফট রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকগুলোকে তাদের নেটওয়ার্ক থেকে বাদ দিয়েছে। সুইফটের মাধ্যমে বিশ্বের ১১ হাজারের বেশি ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন ডলার লেনদেন করে। এটি রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য বড় বিপর্যয়। সোমবার আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করেছে ফিফা ও ইউরোপীয় ফুটবল সংস্থা। এরমধ্যে ২০২২ সালের বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের ম্যাচও রয়েছে। এর আগে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ক্রীড়া সংস্থাগুলোকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে রুশ অ্যাথলেটদের বাদ দেওয়ার আহ্বান জানায়। এরপর যখন আন্তর্জাতিক আইস হকি ফেডারেশন ও ন্যাশনাল হকি লিগ রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের পদক্ষেপ ঘোষণা করে, তখন স্পষ্ট হয় যে এমন কিছু চলছে যা ক্রীড়া ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে দেখা যায়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালের পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে জার্মানি বিস্ময়কর পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটি ঘোষণা দিয়েছে, ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করবে। এই সিদ্ধান্তকে ‘নতুন বাস্তবতা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস। সচরাচর বিরোধ এড়িয়ে চলা ফিনল্যান্ড ও সুইডেন রাশিয়াবিরোধী সম্ভাব্য অবস্থান নিচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি বিষয়ক দফতরের প্রধান গাই পারমেলিন জানান, তারা রাশিয়া ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন। ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে কৃষ্ণ সাগরের সংযোগ স্থাপনকারী তুরস্কের দুই প্রণালীতে যুদ্ধজাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধের উত্তেজনা কমাতে এই উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। অথচ তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক দেশই রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সরাসরি প্রভাব না ফেললেও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্যের উদ্যোগও গুরুত্বপূর্ণ। পেনসিলভানিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, ভারমন্ট, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ও মাইন তাদের বারগুলোতে ভদকাসহ রুশ পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মঙ্গলবার বহুজাতিক কয়েকটি কোম্পানি রাশিয়া থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। আর শেল, বিপি ও নরওয়ের ইকুইনর জানিয়েছে, তারাও মস্কো ছাড়বে। ইলিনয়েসভিত্তিক নর্থ সেন্ট্রাল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম মাক বলেন, শুরুতে এগুলো ছিল প্রতীকী। কিন্তু এরপর একে একে নিষেধাজ্ঞা ও পদক্ষেপ আসতেই থাকে। আলাদা করে এগুলোকে তুচ্ছ মনে হতো। পারে কিন্তু একসঙ্গে বিচার করে দেখলে মনে হবে পুরো ব্যবস্থা নড়েচড়ে বসেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ত্বরিত গতির এসব পদক্ষেপ সোমবার হোয়াইট হাউজের প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রেস সচিব জেন সাকি বলেছেন, আধুনিক ইতিহাসে ন্যাটোকে ঐক্যবদ্ধ করতে বড় ভূমিকা রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের। ফলে আমার মনে হয় এজন্য পুতিনকে আমরা ধন্যবাদ জানাতে পারি।
তিনি বলেন, আমার মনে হয় গত কয়েক দিন ধরে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনকে তার পদক্ষেপের জন্য দৃঢ় বার্তা পাঠানোর অঙ্গীকার প্রত্যক্ষ করছি। পুতিনের পদক্ষেপ, বাগাড়ম্বর অগ্রহণযোগ্য এবং বিশ্ব এর বিরুদ্ধে একটি দেয়াল নির্মাণ করছে। ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রিউ লাথাম বলেন, এক প্রজন্ম আগে এমন কিছু ঘটলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সন্ধ্যার খবরে জানা যেতো। কিন্তু এখনকার মতো দ্রুত আন্তসংযোগ থাকতো না। আমার মনে হয় এটি প্রভাব বাড়িয়ে দিচ্ছে। একেবারে বিশ্বের সবাই রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার দিকে ছুটছে না। ইউক্রেন ইস্যুতে পুরো দুনিয়ার স্রোতের বিপরীতে চীন। এতে অবশ্য খুব বেশি অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। তবে দেশটি বলে আসছে যেকোনও দেশের সার্বভৌমত্বকে অন্য দেশের শ্রদ্ধার জানাতে হবে। অবশ্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও পদক্ষেপ নিতে রাজি নয় বেইজিং। তবে নীরবে চীনের রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রুশ অর্থনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখছে।
এপি অবলম্বনে।