ভাটা পড়েছে প্রবাসী আয়ে

0

আলতাফ হোসাইন॥ আকস্মিকভাবে ভাটা পড়েছে প্রবাসী আয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে ১৭ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে ৬৮ কোটি ৫৪ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১২৭ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার। এ ছাড়া চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। যা গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ২৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলার বা ১৩ শতাংশ কম।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সনির্ভরতা রয়েছে। তাই হঠাৎ করে এর প্রবাহ কমে গেলে সংগত কারণেই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি হয়। গত বছর রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি থাকায় যেমন দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে সহায়তা করেছিল, তেমনি প্রবাহ কমে গেলেও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সংশ্লিষ্টরা বল?ছেন, গত বছর করোনার সময় প্রবাসীরা তাদের জমানো টাকা দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময় হুন্ডি কিংবা অবৈধ চ্যানেলগুলো বন্ধ থাকায় সবাই বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠিয়েছিলেন। একারণে গত বছর রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি ছিল। তবে, এ বছর করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে বহির্বিশ্বের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বেড়েছে। তাই এখন ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরেও অর্থ আদান-প্রদান হচ্ছে। ফলে চলতি অর্থবছরে বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। যদিও বাংলাদেশের অন্যান্য সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্সের এই প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত বছর করোনার প্রকোপ থাকায় লোকজন আসতে না পেরে টাকা পাঠিয়ে দিতো। কিন্তু এখন সবকিছু সচল হওয়ায় মানুষ সঙ্গে করেও টাকা নিয়ে আসছে। করোনার সময়ে বেশি এসেছিল, সেটা তো রেফারেন্স হিসেবে দাঁড় করানো যায় না। তখন যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে সেটা স্বাভাবিক ছিল না, বরং বেশিই ছিল। কাজেই সে সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। তুলনা করলে বলা যায় গত বছরের চেয়ে কম। কিন্তু এখন যেটা আসছে এটাই স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান-সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত বছর হুন্ডি কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে টাকা আসা বন্ধ ছিল। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসার কারণে প্রবৃদ্ধি বেশি ছিল। এখন সবকিছু সচল হওয়াতে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অন্যান্য মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসছে। ফলে এ বছর হয়তো কম দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার পেছনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে যে, কি পরিমাণ লোক এখন বাইরে আছে সেটা দেখার প্রয়োজন রয়েছে। যারা সে সময় চলে এসেছিলেন তারা আবার কাজে ফিরতে পেরেছেন কিনা সেটাও দেখতে হবে। যে সমস্ত পরিবার প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল, বা যাদের পুনরায় কাজে ফেরার প্রত্যাশা ছিল, তারা ফিরতে পারছেন কিনা সেটাও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার একটা প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যদিও এটি সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে খুব একটা দুর্ভাবনার কারণ নয়। কারণ আমাদের রিজার্ভ যথেষ্ট উদ্বৃত্ত রয়েছে। তবে যেসব পরিবার এই রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল, তাদের ওপরে কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, প্রবাসী আয় কমে গেলে অবশ্যই অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ে। কারণ দেশের বড় একটি আয় হলো রেমিট্যান্স। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স যেটা আছে, সেখানে রেমিট্যান্স বাড়লে যেমন পজেটিভ হয়, তেমনি কমে গেলে তখন সেটা নেগেটিভ হয়। কমে গেলে এতে ফরেন এক্সচেঞ্জের ওপর চাপ পড়ে। এখন যেটা হচ্ছে টাকার মূল্যমানের ওপর চাপ পড়ছে।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এখন এক্সপোর্টও তেমন বাড়েনি, সেখানে রেমিট্যান্সও কম আসাটা আমাদের জন্য ভালো না। রেমিট্যান্স কমে গেছে, তার মানে প্রবাসীদের আয় কমে গেছে। সেটা তো চিন্তার বিষয়। তিনি বলেন, আগের সময়গুলোর তুলনায় বর্তমানে রেমিট্যান্স প্রবাহ যদি স্বাভাবিক হয়েও থাকে তবুও এটার ফলাফল ভালো না, আয় বাড়াতে হবে। কারণ কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স অনেক নেগেটিভ হয়ে গেছে। ব্যালেন্স নেগেটিভ হলে সরকারের খরচ বাড়বে। সরকারের তো ব্যয় করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ১৯৪ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ এক লাখ ২ হাজার ৭১৮ কো?টি টাকা। রেমিট্যান্সের এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯৬ কোটি ডলার বা প্রায় ২০ শতাংশ কম। গত অর্থবছর একই সময় এসেছিল এক হাজার ৪৯০ কোটি ডলার। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ কোটি ৩২ লাখ মার্কিন ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৩ কোটি ৬৮ লাখ মার্কিন ডলার। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ২৮ লাখ মার্কিন ডলার। এ ছাড়া দু’টি বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে একটিতে এসেছে এক কোটি ২৭ লাখ মার্কিন ডলার। আরেকটিতে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি। অন্যদিকে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৯ কোটি ৫৬ লাখ মার্কিন ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ৯৫ কোটি ৬১ লাখ মার্কিন ডলার। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে ৩৫ লাখ মার্কিন ডলার এবং দু’টি বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে একটিতে এসেছিল দুই কোটি ২২ লাখ মার্কিন ডলার। গত অর্থবছর অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। ওই অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে।