যে কারণে বরখাস্ত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার জেলায় বর্তমানে ৭০টির বেশি উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ হচ্ছে, উন্নয়নমূলক কাজ এবং দুর্নীতি – দুটোই সমান তালে চলছে সেখানে। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যাপক দুর্নীতিও হচ্ছে।’ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে চরম অব্যবস্থাপনা চলছে কক্সবাজারে। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে মানুষকে নানাভাবে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব দুর্নীতির পেছনে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদরা একাট্টা হয়েছেন। কক্সবাজার নাগরিক সোসাইটির সদস্য আ ন ম হেলাল বলেন, ‘প্রভাবশালী আমলা ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের বজ্রকঠিন সিন্ডিকেট।’ কক্সবাজারে বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে হেলাল বলেন, সেখানে দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানানো হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে এই বিষয় উঠে এসেছিল। যে কর্মকর্তা এই তদন্ত করেছিলেন, তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার পর কক্সবাজারের দুর্নীতি নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন কী করেছিলেন?
দুই বছর আগে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন সার্ভেয়ারের বাড়িতে র‍্যাব অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ নগদ টাকা, জমি অধিগ্রহণের চেক ও কাগজপত্র উদ্ধার করে। এগুলো থাকার কথা ছিল জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে, কারো বাড়িতে নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। কমিশনের কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন যে তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্ত করেছিলেন সেগুলো হচ্ছে – কক্সবাজার পানি শোধনাগার প্রকল্প, ইস্টার্ন রিফাইনারি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং ইন্সটলেশন এবং পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনের ভবন নির্মাণ। এই তিন প্রকল্পের জন্যই জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। শরীফ উদ্দিন তদন্ত প্রতিবেদনে দেখান, এই তিন প্রকল্পেই প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদের সংযোগে কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের ভবন নির্মাণের জন্য যখন জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছিল, তখন জমি হারাতে বসেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা এন আলম। তিনি জানান, তার জমি অন্যদের নামে দেখিয়ে অধিগ্রহণের পায়তারা করেছিল দালাল চক্র এবং জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কমিটির লোকজন। শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে তিনি জায়গা টিকিয়ে রেখেছেন। এন আলম বলেন, ‘ওরা বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভুয়া মালিক সাজিয়ে টাকা উত্তোলন করেছিলো।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া এই কাজ করা কি সম্ভব?’ ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব দুর্নীতির কথা দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল সেগুলো হচ্ছে – ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়ার ক্ষেত্রে কমিশন আদায় করা, একজনের জমি অন্যজনের নামে দেখানো, বেশি দামে জমি কেনা, সরকারি অন্য আরেকটি সংস্থার অধিগ্রহণ করা জমি নতুন করে অধিগ্রহণ করা। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রাশেদুল ইসলাম জানান, এসব অভিযোগ মিথ্যা নয়। বিষয়গুলো অনেকটা ওপেন সিক্রেট ছিল। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি তো হয়েছে অনেক। শত শত অভিযোগ আছে। এগুলো প্রকাশ্যেই হয়, এখনো হচ্ছে।’
প্রভাবশালীদের নাম দেয়ায় বরখাস্ত?
দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন অভিযোগ করেন, প্রায় আটমাস আগে চট্টগ্রাম কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও সেটির ভিত্তিতে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন। উল্টো তাকেকে বদলি করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। শরীফ উদ্দিন জানান, এই তদন্ত প্রতিবেদন থেকে প্রভাবশালী আমলা ও রাজনীতিবিদদের নাম বাদ দেবার জন্য তার উপর চাপ এসেছিলো। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম বলেছেন, শরীফ উদ্দিনের তদন্তের সাথে তাকে বরখাস্ত করার কোনো সম্পর্ক নেই। চাকুরি বিধি না মানায় শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। খুরশিদ আলম বলেন, যখন কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় তখন কমিশন সেটি পর্যালোচনা করে এবং আইনগত দিক খতিয়ে দেখে। কোথাও ঘাটতি থাকলে সেটি নিয়ে অধিকতর তদন্ত হতে পারে। তিনি বলেন, প্রতিটি তদন্ত নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের কিছু প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা থাকে। তারা যদি মনে করে সেসব প্রশ্নের উত্তর তদন্ত প্রতিবেদনে নেই তাহলে কমিশন চাইলে অধিকতর তদন্তের জন্য পাঠাতে পারে। খুরশিদ আলম বলেন, কয়েকটি বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন তার আইনগত এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে চাকরি বিধির গুরুতর লঙ্ঘন করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন কারণ যাই বলুক না কেন, কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ হচ্ছে, এতো বড় আকারের দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তারা দেখছেন না। কক্সবাজার নাগরিক সোসাইটির সদস্য আ ন ম হেলাল আক্ষেপ করেন, ‘কোন লেভেল থেকে দুর্নীতি হচ্ছে, কিভাবে কক্সবাজারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এগুলো উচ্চ পর্যায়ে বলার সুযোগ আমাদের নেই।’ ভূমি অধিগ্রহণের দুর্নীতির প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। অবশ্য যখন এসব দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল তখনকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এখন সেখানে কর্মরত নেই। কারো কারো পদোন্নতিও হয়েছে। তবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধিগ্রহণ শাখার অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ সালেহউদ্দীন বলেছেন, কক্সবাজারে যেসব জায়গায় জমি অধিগ্রহণ নিয়ে দুর্নীতির কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে তাদের কাছে কেউ কখনো অভিযোগ করেনি।
সূত্র : বিবিসি