বিমানে হচ্ছেটা কী?

0

অবস্থাদৃষ্টে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাংলাদেশ বিমান সীমাহীন অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রায়ই পত্রপত্রিকায় এর অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ক’দিন আগে পত্রিকান্তরে এমন একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করেছে। যাত্রাবাহী ৮টি উড়োজাহাজে কার্গো বহন করতে গিয়ে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ই আর, ২টি ৭৩৭ এবং ভাড়ায় আনা দুটি এয়ারক্রাপট। এসব উড়োজাহাজের শতাধিক আসনের হাতল দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। আংশিক বা পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে অর্ধশতাধিক আসন। বিকল ও যান্ত্রিক ত্রুটি সৃষ্টি হয়েছে ৭০টির বেশি মুভিসেটের। এছাড়া নষ্ট হয়েছে ইন্টেরিয়ার ডেকোরেটর, টয়লেট, ফ্লোর, দেয়াল, খাবার রাখার গ্যালারিসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র। কাদা, রং আর কেমিক্যালে নষ্ট হয়েছে আসনের কাপড়, ভেতরের দেয়াল এবং দেয়ালের নান্দনিক চিত্রকর্ম। উড়োজাহাজগুলোর এসব বিনষ্টের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকার ওপর বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই বিশাল ক্ষতি হয়েছে মাত্র কয়েক কোটি টাকা মুনাফার বিপরীতে। খবরে আরো জানানো হয়েছে, ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজগুলোর এতটাই ক্ষতি হয়েছে যে, মালিকপক্ষ সেগুলো নিতে চাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ বিমানকে এসব উড়োজাহাজ কিনে নিতে হবে। বাস্তবতা এমন, উড়োজাহাজগুলো কিনে নেয়ার আর্থিক সামর্থ বাংলাদেশ বিমানের নেই। জানা গেছে, বিকল্প হিসেবে মেরামতসহ উড়োজাহাজগুলোর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। প্রশ্ন হলো, এই ক্ষতিপূরণ ও খরচের অর্থ কে দেবে? কোথা থেকে আসবে এ অর্থ? বিমানের লোকসান ও লুটপাট নিয়ে বরাবরই উদ্বেগের অবধি নেই। কার্যত সংস্থাটি জাতির ঘাড়ে বোঝায় পরিণত হয়েছে। অথচ, এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কিন্তু খারাপ অবস্থায় নেই। তাদের দিন আরামে-স্বস্তিতে, বিলাসব্যাসনেই কাটছে। দেশের পতাকা বহনকারী সংস্থাটি মোটেই স্বমর্যাদায় অবস্থান করছে না। একে টিকিয়ে রাখতে এবং এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে গিয়ে জনগণের ট্যাক্সের টাকা অকাতরে ব্যয় করা হচ্ছে। কতদিন আর এভাবে চলবে, সেটাই পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা।
বাংলাদেশ বিমানের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আছে। এমডি, পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। আছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নামের একটি মন্ত্রণালয়। আছেন তার মন্ত্রী, সচিব ও অন্য কর্মকর্তারা। প্রশ্ন উঠতে পারে, তারা তাহলে কী করছেন? তারা সবাই বহাল তবিয়তে থাকতেও যাত্রীবাহী বিমানে কার্গো বহনের সিদ্ধান্ত বা ব্যবস্থা কীভাবে হলো? খবরে জানা গেছে, শুরুতে বিমানেরই একটি সিন্ডিকেট এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। সিন্ডিকেটে ছিলেন বিমানের কিছু কর্মকর্তা, বিশেষ করে দুই পরিচালক ও একজন পাইলট। এ সম্পর্কে মন্ত্রী, সচিব, এমডি কিছুই জানতেন না বা জানেন না, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। বিমান কর্তৃপক্ষের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ এবং মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবসহ অন্যরা সতর্ক থাকলে, তাদের নিয়মিত তদারকি ও নজরদারি নিশ্চিত হলে এমন অনিয়ম ও ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। বিমানের এ ধরনের নামে ক্ষতি প্রায়শই ঘটতে দেখা যায়। গত ১ ফেব্রুয়ারি পাইলটের খামখেয়ালির কারণে একটি উড়োজাহাজের (S2-AKD) দুটি ইঞ্জিনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্টস জ্বলে যায় বলে এক খবরে জানা গেছে। বলা হয়েছে, সিলেট থেকে ঢাকার পথে উড়াল দেয়া উড়োজাহাজটিতে কোনো কারণ ছাড়াই পাইলট পাওয়ার লিভারটিতে ১০০ ভাগের বেশি পাওয়ার ব্যবহার করেন। পরে তাড়াতাড়ি করে পাওয়ার লিভারটি শত ভাগের জায়গায় নিয়ে আসেন। এতে ১৩ সেকেন্ড সময় লাগে। এর মধ্যেই ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ এমনকি দুটি ইঞ্জিনই জ্বলে গিয়ে থাকতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, উড়োজাহাজটির ক্ষতি হতে পারে ৬০ কোটি টাকা। এর মেরামতে তিন মাস ব্যয় হতে পারে। তাতে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় ক্ষয়ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। কেন পাইলট ওইভাবে পাওয়ার লিভারটি ব্যবহার করেন, তা জানা যায়নি। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা সেটাও অজানা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীকে পর্যন্ত যথাসময়ে বিষয়টি অবহিত করা হয়নি। জিজ্ঞাসিত হয়ে তিনি জানিয়েছেন, এত বড় দুর্ঘটনার কথা তাকে জানানো হয়নি। বাংলাদেশ বিমানের কার্যব্যবস্থা কীভাবে চলছে, এ ঘটনা থেকে তার কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায়।
বিমানের যে কোনো ক্ষতি মানে দেশের ক্ষতি, জনগণের ক্ষতি। বছরের পর বছর এমনধারা ক্ষতি বহন করার সামর্থ দেশের অর্থনীতির নেই। অবশ্যই সব ধরনের ক্ষতি ও লুটপাট বন্ধ করতে হবে। বিমানের ক্ষতি- লোকসান পোষাতে যাত্রীভাড়া বৃদ্ধি একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনো অনেক উড়োজাহাজ সংস্থার ভাড়ার চেয়ে বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া বেশি। ভাড়া বেশি হলেও সেবায় তার অবস্থান কিন্তু নিম্নতম। অতিরিক্ত ভাড়া ও নিম্নমানের সেবার জন্য পারতপক্ষে বাংলাদেশ বিমানে কেউ যাত্রী হতে চায় না। বিমানকে নির্ভরযোগ্য, সেবানিষ্ট সময়ানুগ ও সাশ্রয়ী করা না গেলে এর আয়বর্ধন ও বিকাশ নিশ্চিত করা যাবে না। আর এ সবের পূর্বশর্ত হিসেবে তাকে সব ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, অপচয় ও লুটপাটের বাইরে নিয়ে আসতে হবে। এর পরিচালন ব্যবস্থায় আনতে হবে সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গতিশীলতা। বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়কে এদিকে নজর নিবন্ধ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও ক্ষতির অনুপুংখ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নির্ধারণ করতে হবে। বিমানের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে পারে না। এর পরিবর্তন অপরিহার্য।