ইউক্রেন, সম্পর্কের পারদ ওঠে নামে

0

ড. মাহবুব হাসান
এই শীতকালে তাপমান যন্ত্রের পারদ নিচের দিকে নেমে থাকার কথা। সেটা প্রাকৃতিক কারণেই হয়ে থাকে। কিন্তু সম্পর্কের পারদ উপরের দিকে ধাবমান আজ, এই তুষারাক্রান্ত শীতকালেও। মানবসমাজের সহাবস্থানের ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্কের পারদ আজ উভয় দিক থেকেই উপরের দিকে উঠছে। তা যেন থামার কোনো লক্ষণ নেই। দু’পক্ষই একের পর এক তুরুপের তাস খেলে চলেছেন। বাক্যবিনিময় তো ছিলই, বাক্যবাণ ছোড়া হয়েছে মহাকাশপথে, আর তার কেন্দ্র হচ্ছে ইউক্রেন। পশ্চিমাঘেঁষা দেশ যেমন ইউক্রেন, তেমনি রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশও। বলা যেতে পারে দেশটি রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যকার এক সেতুবন্ধ। রাশিয়া থেকে যত জ্বালানি তেল ও গ্যাস রফতানি হয় ইউরোপে তার প্রায় সব পাইপলাইনের মাধ্যমে। সেসব পাইপলাইন গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে। ফলে ইউক্রেন রাশিয়া ও ইউরোপের সংযোগ দেশ হয়ে ওঠায় এর গুরুত্ব নানা কারণে। প্রথমত বাণিজ্যের কারণে রাশিয়া চায় ইউক্রেনের ক্ষমতায় এমন একজন থাকুন, যিনি রাজনৈতিকভাবে ও মানসিকভাবে হবে রাশিয়ানপন্থী। ওই দেশটায় বসবাস করেন জাতিগত রাশিয়ানদের একটি বড় অংশ। তারা এখন রাশিয়ার পক্ষে কাজ করছে। যারা পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশের পক্ষে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিসহ, তারা ইউরোর দিকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ক্ষমতায় বসেছিল মস্কোপন্থী সরকার। তিনি চেষ্টা করেছিলেন ইউরোপের উন্নয়ন সহযোগিতায় দেশের উন্নয়ন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক সহ্য করেননি রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন। তারই সামরিক সহযোগিতায় রাশিয়ানপন্থীরা রাজনৈতিক প্রতিবাদের উচ্ছৃঙ্খলতা সৃষ্টি করলে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে পালতে বাধ্য হন। এই সুযোগে ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। বহুদিন ধরেই এই দ্বীপটি নিজেদের করতলে নেয়ার চেষ্টায় ছিল রাশিয়া। কারণ এই দ্বীপটি রাশিয়ার জন্য একমাত্র উষ্ণ পানির উৎস। রাশিয়ার লোকেরাই কেবল নয়, পৃথিবীর মানুষেরাও জানেন শীত ও বরফপ্রধান দেশে গরম ও মিঠা পানির মূল্য কতটা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন কালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ইউক্রেনের সাথে জুড়ে দেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। সেই থেকে, সেই ১৯৫৪ সাল থেকেই ক্রিমিয়া ইউক্রেনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভেঙে পড়ার মুহূর্তে তো আর কিছু করার মন থাকে না ক্ষমতাবানদের, তাই ক্রিমিয়ার কথাও তারা ভাবেননি। কিন্তু এককালের গোয়েন্দা, কেজিবির প্রধান পুতিন কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে আবির্ভূত হলে, তিনি তক্কে তক্কে ছিলেন, কী করে ক্রিমিয়া দখল করা যায়। সেই কাজ সম্পন্ন করার পর তিনি বাদ সাধলেন ইউক্রেনকে ইইউ ও ন্যাটোর সদস্য করার উদ্যোগে। রাশিয়ার এই দাবি আমেরিকা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি কিছুটা হলেও পাল্টে গেছে। ইউক্রেন নিয়ে সমরসজ্জা যতই এগিয়ে যাক না কেন, ন্যাটোর মহাসচিব বলেছেন, সদস্য দেশ নয় এমন কোনো রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধে যেতে তারা প্রস্তুত নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দেশটা আমেরিকা, সে বাধ্য করবে ন্যাটোকে তার পক্ষে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে। দেশটির উন্নয়নের স্বার্থে এই উভয় পক্ষই চায় রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে চলতে। মূলত সোভিয়েত পরবর্তী কাল থেকেই ইউক্রেনে রাজনৈতিক বিরোধের সূত্রপাত এখান থেকেই। রাশিয়া চায় না ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিক। সেটা হলে তার পরবর্তী পদক্ষেপই হবে ন্যাটোর সদস্য হওয়া। এটা রাশিয়া হতে দিতে চায় না। কারণ, তার রয়েছে বাণিজ্য স্বার্থ, রয়েছে সামরিক স্বার্থ, রয়েছে নিজ দেশের স্বার্থ। এ-সবের সাথে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থ কিন্তু খাটো করে দেখার বিষয় নয়। পুতিন যে রাশিয়ায় বহু বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন, তার পেছনেও আছে এসব আন্তর্জাতিক বিষয় ও সম্পর্কের টানাপড়েনের অদৃশ্য-প্রায় রাজনৈতিক কাহিনী। অবশ্যই এসব কাহিনীর প্রধান ও প্রথম উপাদান হচ্ছে জনগণ। কিন্তু জনগণের স্বার্থের চেয়ে ক্ষমতার স্বার্থ সবচেয়ে বড় ও বেশি। ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার সামরিক ও মানসিক দ্বন্ধ্বের কারণ এখানেই নিহিত।
২.
গত মঙ্গলবার, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আরো সৈন্য পাঠাচ্ছেন ন্যাটোর পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে। সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। জার্মানিতেও পাঠাবেন সেনা। মানে হলো, রাশিয়া যেমন ইউক্রেনের সীমান্তে লাখো সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম উপস্থিত করেছে, তেমনি আমেরিকাও করছে জার্মানি ও ফ্রান্সে। কেন করছে? রাশিয়াকে রাজনৈতিক ও সামরিক চাপের মধ্যে ফেলতে। রাশিয়া যাতে মাথা নত করে বলে যে ঠিক আছে তোমরা ইউক্রেনকে ইইউভুক্ত করে নাও, ন্যাটোতে জায়গা দাও, কিন্তু তার বিনিময়ে আমাকে কী কী দেবে, বলো? আমেরিকার মূল লক্ষ্য এটাই। ইউক্রেন যুক্ত হলেই যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তি অপ্রতিরোধ্য ও সর্বোচ্চ হবে এমন নয়। এটা হলো সামরিক রাজনৈতিক খেলা। এর সাথে জড়িয়ে আছে সামরিক সরঞ্জামের বাণিজ্য। বাণিজ্যে বসতি ল²ী বলে যে কথাটা বাংলায় চালু আছে সেই ধারাটা চালু রাখা। পুতিন বলেছেন ইউক্রেনের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশের পেছনে তার কোনো সামরিক অভিলাষ/অভিসন্ধি নেই। কিন্তু লাখো সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সমাবেশের পেছনে আছে আমেরিকা ও ইউরোপকে প্রচ্ছন্ন হুমকি যে ইউক্রেনকে জোটভুক্ত না করার আহ্বানের পোক্ত ভিত রচনা। ধরা যাক, ইউক্রেন ইইউভুক্ত হলো, ন্যাটোর সদস্যও হলো। তাতে রাশিয়ার কী করার আছে? সে কি ক্রিমিয়া দখলের মতো ইউক্রেন দখল করে নেবে? সেটা করলে যে আরো একটি বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হতে পারে সেটা পুতিন ভালোভাবেই জানেন। তাই তিনি যুদ্ধে যেতে চান না। রবং তিনি উল্টো করে বলেছেন বাইডেন চাইছেন তাকে (রাশিয়াকে) যুদ্ধে টেনে নামাতে। এটা যে সাফাই পুতিনের তা বুঝতে না পারার কারণ নেই। কিংবা তিনি চান সামরিক ও রাজনৈতিক চাপটি থাক। গত দেড় মাস ধরে ইউক্রেন সমস্যা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রে লাট্টুর মতো চক্কর খাচ্ছে। অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে না যে ইউক্রেন প্রশ্নে কেউ ছাড় দেবে। তবে, তারা যে অন্ধের মতো এগুচ্ছে না, সেটাও বোঝার আছে। হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট রাশিয়া সফর করছেন। আবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যাচ্ছেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে, সেখানে যাওয়ার কথা আছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানেরও। তারা সবাই যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে সাহস জোগাতে যাচ্ছেন সেটাও বোধগম্য। বিশ্ববাসীও বুঝছে, পশ্চিমাদের সামরিক ইউনিটি। নিরাপত্তা বিষয়ে সবাই সজাগ তাতে সন্দেহ নেই। এর মধ্যেই আমরা জেনেছি, আমেরিকা ২.৭ বিলিয়ন মূল্যের যুদ্ধসরঞ্জাম পাঠিয়েছে ইউক্রেনে। অর্থাৎ সামরিক ধমক আর ধমকির পেছনে রয়েছে সামরিক সরঞ্জামের বিক্রি-বাট্টাও, এটা আমরা সব সময়ই ভুলে থাকি। যুদ্ধ লাগার আগেই এই বাণিজ্য করে নেবে পুঁজিবাদী বিশ্ব। কি করে পুঁজির সমৃদ্ধি করতে হয়, সেই কৌশল তারা ভালো জানে। যদি সত্যই যুদ্ধ বাধে, মানে রাশিয়া যদি সামরিক বাহিনী ঢুকিয়ে দেয় ইউক্রেনে, তাহলে কি ন্যাটো চারদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বে রাশিয়ার ওপরে? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর আগেই আমরা শুনেছি, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আক্রমণ চালায় তাহলে বাইডেনের ভাষায় রাশিয়া বড় ধরনের ভুল করবে এবং সব রকম অবরোধের মধ্যে পড়বে। তার মানে হচ্ছে যত রকম বাণিজ্য আছে, যত রকম সাহায্য-সহযোগিতা চলমান, সেগুলো কার্টেল করা হবে। সেখানে মানবিক সহায়তা খাদ্যশস্যের জোগানও বন্ধ করে দেবে। ফলে রাশিয়া মহাসঙ্কটে পড়বে। ঠিক বিপরীত চিত্রও আছে। রাশিয়া ইউরোপে তার জ্বালানি রফতানি বন্ধ করে দেবে। জার্মানি তার জ্বালানির ৫০ শতাংশের জোগান পায় রাশিয়া থেকে। মানে জ্বালানি সঙ্কটে পড়বে জার্মানিসহ গোটা ইউরোপ। শুধু জার্মানি নয়, ইউরোপের অনেক দেশই জ্বালানি আমদানি করে রাশিয়া থেকে। রাশিয়ার জ্বালানির সরবরাহ বন্ধ করে দিলে মহাসমর বাধতে সময় লাগবে না। আর কে না জানে, পৃথিবীর ক্ষুধার্ত মানুষের দিকে, না পুঁজিবাদী বিশ্বের চোখ আছে, না সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়ার দৃষ্টি আছে। পুঁজির পৃথিবীতে মানুষের মূল্য আছে, তবে তার স্থান অর্থের সরণির পর, নিচে।
৩.
সম্পর্ক যে স্বার্থের অন্য নাম হতে পারে, তা বিশ্ব রাজনীতিকরা ভালোভাবেই জানেন ও বোঝেন। এই জানা ও বোঝার ভেতরে আছে আরো নানান উপ-স্বার্থ ও পার্শ্ব-স্বার্থ। সেগুলো চোরা-স্রোতের মতোই চলমান।আপাতত এই সিনে চীনকে দেখা যাচ্ছে না। সে ঘাপটি মেরে বসে আছে। পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তা পরখ করে চলেছে। কারণ রাশিয়ার সাথে তার মিত্রতা আছে, কিন্তু গভীরতর কোনো কিছু নয়। সেই মিত্রতা হচ্ছে শত্রুর শত্রু হচ্ছে তার বন্ধু- এইভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নানা বিষয়েই বিরোধ আছে চীনের। বিশেষ করে দক্ষিণ, উত্তর চীন সাগর নিয়ে আর ইন্দো-প্যাসিফিক প্রশ্নে ওই বিরোধ বর্তমান বিশ্বের এক আলোচিত বিষয়। সম্পর্কের এই টানাপড়েন নিয়েও চলে বাণিজ্য। যেমন ফ্রান্সের কাছ থেকে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন কেনার চুক্তি থেকে অস্ট্রেলিয়াকে ছিনিয়ে নিয়েছে তাদেরই বন্ধু দেশ আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য। ফ্রান্স সে সময় খুব ক্ষেপেছিল। কিন্তু একই রাজনৈতিক ও সামরিক জোটের ভেতরে থাকলে লাভ-ক্ষতির চুলচেরা হিসাব নেয়া যায় না। ফ্রান্স তাই ওই ৪০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি মেনে নিয়েছে। এখন, এই যুদ্ধের ম ম গন্ধের সুবাদে ন্যাটোর অন্যদেশে বিক্রি করবে প্রয়োজনীয় সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম। ইউরোপের গরিব দেশগুলো (তুলনামূলকভাবে গরিব) ন্যাটোর সদস্য হওয়ার খাতিরে সে অস্ত্র কিনবে। এই বাণিজ্যগুলো চোরা-স্রোতের মতোই, দেখা যায় না, কিন্তু তা চলছে। রাশিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখতে হবে- ন্যাটোর নেতা যুক্তরাষ্ট্রের এই দৃষ্টিভঙ্গিই অনুসরণ করবে তারা। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থ দেখার চেয়ে আমেরিকার নির্দেশ মানতে বাধ্য হবে তারা। ইউক্রেন সঙ্কট আলোচনার টেবিলে আসবে খুবই দ্রæত। কারণ গত দেড় মাস ধরে যে সামরিক ও রাজনৈতিক চাপ চলছে, তার ইতি টানতে না পারলে, তার খেসারত বিশ্বরাজনীতিকদের দিতে হবে। ইউক্রেন পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলেই আবার শুরু হবে ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে নতুন সামরিক-রাজনৈতিক প্রণোদনা। অথবা মালাবার স্ট্রেইট নিয়ে আরেকটি অভিযোগের সূচনা হবে, যা গোটা এশিয়ার পূর্বাংশের দেশগুলোকে সামরিক ও রাজনৈতিক চাপের মধ্যে ফেলে দেবে। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। আমরা আরো একটি সঙ্ঘাতপূর্ণ সামরিক রাজনীতির মুখোমুখি হতে পারি, যা বিশ্বকে আবারো কাঁপিয়ে তুলবে। তবে, পারমাণবিক যুদ্ধ হবে না, এটা নিশ্চিত।