ঋণপত্রে বিশেষ ধারা : অশনিসঙ্কেত

0

গত বছরের ডিসেম্বরের ১০ তারিখে বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাব-পুলিশের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ট্রেজারি বিভাগ একযোগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র দফতরে ডেকে এনে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। সেই সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও জানানো হয়। কয়েক সপ্তাহ পর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের প্রধান রফতানিখাতের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়ে বিজিএমইএ’র তরফ থেকে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে তখনো কোনো প্রভাব না পড়ার কথা জানান বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। গতকাল ঢাকার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেশের তৈরী পোশাক খাতের রফতানি এলসিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়ার খবর জানা যায়। বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের(বিজিবিএ) সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেনের বরাতে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি গার্মেন্ট ক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠানো ঋণপত্রে নিষেধাজ্ঞার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার কারণে আর্থিক লেনদেন বন্ধ বা স্থগিত হয়ে যেতে পারে বলে একটি বিশেষ ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে। ঋণপত্রে এ ধরণের ধারা সংযোগ এবারই প্রথম। ধীরে ধীরে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এমন ধারা যোগ করতে পারে বলে পোশাক খাতের সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দেশের পোশাক রফতানিকারকরা যতই আশাবাদী হোন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ এবং সম্প্রসারণ সীমিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্টরা যতই প্রয়াস চালান না কেন, তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব এখনো দেখা যাচ্ছে না। গত সপ্তাহে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত‘ মিট দ্য রিপোর্টাস’ সংবাদ সম্মেলনে ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেছিলেন, সাম্প্রতিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে ইউরোপীয় বাণিজ্য সুবিধার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলার কোনো লক্ষণ তিনি দেখছেন না। তার এ আশাবাদী মন্তব্যের এক সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তরাজ্যের ক্রেতার তরফ থেকে শর্তযুক্ত এলসি পাওয়া গেল। অনেকেই একে এক অশনিসংকেত মনে করছেন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যবহৃত ঋণপত্রে নিষেধাজ্ঞা ক্লজের ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়ে বলেছেন, সংশ্লিষ্ট দেশের আইনের বাইরেও এসব ক্লজ প্রয়োগ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কর্মাসের(আইসিসি) পরামর্শ অনুসারে ক্লজ অন্তর্ভুক্ত না করা এবং করলেও সহায়ক অন্য কোনো ধারা সংযুক্তির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে হবে। নির্ভরশীলতা ও বাধ্যবাধকতার কারণে ক্রেতা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ ধরণের ধারা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ খুবই ক্ষীণ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭ কর্মকর্তার উপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব[ কোনো প্রভাব দেশের তৈরী পোশাক রফতানি খাতে পড়ার আশঙ্কা আপাতত না থাকলেও নিষেধাজ্ঞার আওতা বেড়ে গেলে তা এড়ানো অসম্ভব হতে পারে। ইতিমধ্যেই নানা জনের বক্তব্য ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত মতামতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সম্প্রসারিত হওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সাথে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, বিচারহীনতা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধ:পতন এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভ’-রাজনৈতিক বাস্তবতার যোগসুত্র রয়েছে। আমাদের তৈরী পোশাক রফতানি খাতের শতকরা প্রায় ৬৩ভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। নিষেধাজ্ঞা সম্প্রসারিত ও দীর্ঘায়িত হলে দেশের রফতানি বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। দেশের চলমান উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখতে হলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ক’টনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি যে সব অভিযোগের ভিত্তিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, সে সব বিষয়ের উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। শুধুমাত্র লবিস্ট নিয়োগ বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পরিস্থিতি অনুকুলে আনা সম্ভব নয়। দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন, আইনের শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি কঠোরভাবে রোধ করতে হবে। ইতিমধ্যে যে সব গুম-হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কোনো দেশ বা সংস্থার নিষেধাজ্ঞার কারণে নয়, দেশের মানুষের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার সংরক্ষনের প্রয়োজনেই সরকারকে এসব ইস্যুতে মনোনিবেশ করতে হবে। এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় দেশে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে সে বিষয়ে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়ে দেশের পক্ষে কার্যকর ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।