৪৭০০০ গ্রাম পুলিশের কান্না

0

॥আল-আমিন॥
সবুজ মিয়া। ২৩ বছর ধরে তিনি নীলফামারী জেলার ডিমলার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রাম পুলিশের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। গ্রামের নিরাপত্তার পাশাপাশি, সাপ্তাহিক সংশ্লিষ্ট এলাকায় থানায় হাজিরা, ইউনিয়ন পরিষদের নিরাপত্তা, গ্রামে পুলিশ এলে পুলিশকে সহযোগিতা করাসহ তার নানাবিধ কাজের কোনো ফুরসৎ নেই। কিন্তু, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তার পরিবারে সারা বছর লেগে আছে অভাব-অনটন। আর্থিক অনটনের কারণে সন্তানকে বেশি লেখাপড়া করাতে পারেননি। অল্প বয়সেই বিভিন্ন কর্মে সন্তানদের নিয়োজিত করেছেন তিনি। গত করোনা মহামারিতে তার আর্থিক অবস্থা আরও শোচনীয় হয়। শুধু তার নয়, সারা দেশে প্রায় ৪৭ হাজার গ্রামপুলিশের ভাগ্যের কোনো বদল হয়নি।
তাদের দাবি- তাদের চাকরি জাতীয়করণসহ ১৯৭৫ সালের যে ধার্যকৃত বেতন স্কেল ধরা হয়েছিল সেটি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করণ। গ্রামপুলিশের সদস্যরা জানিয়েছেন, স্থানীয় সরকারের অধীনস্ত ও ইউনিয়ন পরিষদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করে থাকে গ্রামপুলিশ। এ ছাড়াও থানা পুলিশ গ্রাম পর্যায়ে যেকোনো কাজ করতে গেলে তাদেরও সহযোগিতা করে থাকেন গ্রামপুলিশের সদস্যরা। রাত-দিন বলে কোনো কথা নেই। যদি থানা পুলিশের সদস্যরা গভীর রাতে গ্রামে কোনো আসামি ধরতে অথবা কোনো অপারেশনে যান তখনো গ্রামপুলিশের সদস্যরা তাদের সহযোগিতা করে থাকেন।
সূত্র জানায়, গ্রামপুলিশের সদস্যরা মূলত কাজ করে থাকেন জেলার ইউনিয়ন পরিষদে। ইউনিয়ন পরিষদের নিরাপত্তাসহ চেয়ারম্যানের অন্যান্য কাজ তারা করে থাকেন। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন নির্বাচন, বিভিন্ন দুর্যোগে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করা ও ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন তারা। গ্রামপুলিশে দু’টি পদ আছে। একজন দফাদারের (প্রধান) নেতৃত্বে ৯ জন (চৌকিদার) সদস্য কাজ করে থাকেন। দফাদারের বেতন ৭ হাজার টাকা। সূত্র জানায়, এই ৭ হাজার টাকার তিনি সাড়ে ৩ হাজার টাকা পান উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিস থেকে আর বাকি অর্ধেক পান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে। চৌকিদারের বেতন ৬৫০০ টাকা। তিনিও দুই স্থান থেকে অর্ধেক করে বেতন পান। এমন অল্প বেতনে গ্রামপুলিশের সদস্যদের জীবন যাপন অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়েছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুর ইউনিয়নের গ্রামপুলিশ মো. তারেক জানান, আমাদের জীবন-জীবিকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অল্প বেতনে আমাদের সংসার চালাতে পারছি না। তিনি আরও জানান, গ্রামপুলিশের সদস্য হিসেবে কাজ করার কারণে আমরা কোথাও কোনো কাজ করতে পারি না। কেউ আমাদের কাজ দেয় না- বলে আমরা সরকারি চাকরি করি। আমাদের দাবি- যেন চাকরি জাতীয়করণ করা হয় এবং ১৯৭৫ সালে যে বেতনের স্কেল ঘোষণা করা হয়েছিল সেটি যেন বাস্তবায়ন করা হয়। নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার গ্রামপুলিশ সুমন জানান, অল্প বেতনের টাকা তুলতে আমাদের কষ্টের শেষ নেই। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে হাতে-পায়ে ধরতে হয়। অনেক সময় তারা বলেন, ফ্যান্ডে টাকা নেই। টাকা আসবে তখন দেয়া হবে। আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে ঘোরাঘুরি করতে হয় বেতনের জন্য। টাঙ্গাইল জেলা সদর থানার গ্রামপুলিশ সদস্য আকবর জানান, আমাদের কাজের কোনো শেষ নেই। গ্রামে যতই গভীর রাতে পুলিশ আসুক গিয়ে তাদের সহযোগিতা করতে হয়। অথচ পুলিশের সদস্যরা কখনই আমাদের কথা বুঝবে না যে, আমরা সারাদিন ইউনিয়ন পরিষদে কাজ করেছি। তিনি আরও জানান, পুলিশের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ডিউটি করতে হয়। আবার ইউনিয়ন পরিষদের অনেক চিঠি ও কাগজপত্র আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসি। এই কষ্টের পরও এত অল্প বেতন তা আবার দুই দপ্তর থেকে ঘোরাঘুরি করে নিতে অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। আমাদের চাকরি জাতীয়করণ ও একটা ভালো সম্মানী পেলে পরিবার পরিজন নিয়ে বাঁচতে পারবো এ বিষয়ে বাংলাদেশ গ্রামপুলিশ বাহিনী কর্মচারী ইউনিয়নের প্রধান উপদেষ্টা কমান্ডার মোকাদ্দেম হোসেন জানান, ‘আমাদের দাবি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭৫ সালের পরিপত্রে গ্রামপুলিশ বাহিনীর ধার্যকৃত জাতীয় বেতন স্কেল স্মারক নম্বর-এস-১/১ ইউ-৫/৭৬/১৮/১ (৬৬) তারিখ ১৭-১-১৯৭৬ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এটি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি আরও জানান, স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রামপুলিশ এমন বৈষম্যের স্বীকার হতে পারে না। আমরা এর দ্রুত সমাধান চাই।