সড়কে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন

0

গতকাল সংবাদ মাধ্যমে একটি খবর ছিল ৩ বন্ধু স্কুলে ভর্তি হয়ে বাড়ি ফিরতে পারেনি। ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল থেকে পড়ে নিহত হয়েছে। আগেরদিন এমন দুর্ঘটনার একাধিক মৃত্যুর খবর ছিল। প্রতিদিনই খবর হচ্ছে দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুর। সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। যাত্রাপথ মৃত্যুর পথে পরিণত হয়েছে। ঘর থেকে বের হয়ে কেউ যে আবার ফিরতে পারবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। সড়ক দুর্ঘটনা এখন এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তার চিত্র দেখলে আঁৎকে উঠতে হয়। বেসরকারি একটি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ৪ হাজার ৬৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোড অ্যান্ড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু গত ডিসেম্বরেই ৩৮৩টি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে ৪১৮ জন। এর মধ্যে রয়েছে ৬৬ জন শিক্ষার্থী। এ হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ১২টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ চিত্র দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সড়ক দুর্ঘটনা কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা একে ‘গণবিধ্বংসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ নতুন কিছু নয়। বহু আগেই এসব কারণ চিহ্নিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, কারণ চিহ্নিত হলেও প্রতিকারের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক দুর্ঘটনার কারণ প্রতিকারে দিনের পর দিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। সড়ক অবরোধ করে তাদের সহপাঠীদের হত্যার বিচার চেয়েছে। সরকারের তরফ থেকে সড়ক নিরাপদ ও দুর্ঘটনার কারণ প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হবে বলা হলেও, তার বাস্তব কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো দুর্ঘটনার হার বেড়ে চলেছে। সাধারণভাবে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে, চালকের বেপরোয়া আচরণ, আনফিট যানবাহন, অতিরিক্ত গতি, চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, নিয়ন্ত্রণ হারানো, মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল, সড়কের অবৈধ দখল, যেখানে সেখানে যানবাহন পার্কিং ও যাত্রী উঠা-নামা করা, অপর্যাপ্ত ট্রাফিক ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। তবে, বেশিরভাগ দুর্ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে, চালকদের বেপরোয়া আচরণ ও গতি। গত মাসের শেষের দিকে রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোডে এনা পরিবহনের একটি বাস সড়কের উঁচু ডিভাইডারের উপর দিয়ে পাশের সড়কে একটি মাইক্রোবাসের উপর গিয়ে পড়ে। এতে বোঝা যায়, চালকরা কতটা বেপরোয়া। এর আগে অদক্ষ চালকের কারণে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালকের বেপরোয়া আচরণ দায়ী। এ নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি এবং গবেষণা সংস্থা প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো চৈতন্য নেই। এর মধ্যেই চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে এবং দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে বেপরোয়া গতিতে। ট্র্যাফিক ও সড়ক ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নেই। এর প্রতিকার না হওয়ায় একের পর এক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। কর্মজীবী যাদের প্রাণ যাচ্ছে, তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। একটি পরিবারের কর্মজীবীর মৃত্যু শুধু সেই পরিবারকে রাস্তায় বসিয়ে দেয়া নয়, দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নে তার যে মেধা ও দক্ষতা, তারও পরিসমাপ্তি ঘটে। অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক হিসেবে দেখানো হয়েছে, গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ৪৫৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যেসব পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, সেসব পরিবারের ক্ষতি নিরূপণ করা সহজ কাজ নয়। দুর্ঘটনার জন্য তারা যেমন দায়ীদের দায়ী করতে পারছে না, তেমনি তাদের ক্ষতিপূরণও হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেপরোয়া ও অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং তাদের গ্রেফতার করা হলেও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হয় না। এক্ষেত্রে পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়ে উঠে। সরকারও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া থেকে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে যে আইন করা হয়, তা আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সাধারণের ভাষায় ছাত্রদের সাথে সরকারের প্রতারণা হয়ে আছে।
দুর্ঘটনা রোধে সড়ক ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা স্থাপন করার বিকল্প নেই। দুর্ঘটনাকে স্রেফ দুর্ঘটনা বা দৈব ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব দায়ী। এ দায় সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারে না। সড়কে দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি আন্তরিক হয়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এ ব্যাপারে সচেতন ও কর্মতৎপর হতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে মানুষ রাস্তায় পিষ্ট হয়ে মরবে আর সরকার কিছ্ইু করতে পারবে না তা হয় না।