ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে

0

কোভিশিল্ড নামে করোনা ভ্যাকসিনের তিন কোটি ডোজ কিনতে গত বছরের ৫ নভেম্বর ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তি অনুসারে বছরের প্রথম দিন ৬০০ কোটি টাকা সেরাম ইনস্টিটিউটের অ্যাকাউন্টে অগ্রিম পাঠানোর পরপরই ভারত সরকার নিজেদের চাহিদা না মিটিয়ে অন্য দেশে টিকা রফতানি না করার নির্দেশনা জারি করে। এতে ভ্যাকনি পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় বাংলাদেশ ভারত সমঝোতা চুক্তিতে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে ভারতের সংশ্লিষ্টরা আশ্বস্ত করলেও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। এতে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। এর ফলে ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের প্রতারণার শিকার হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা মহামারি বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও উন্নয়নের হুমকি হয়ে রয়েছে। মহামারীর শুরু থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন আবিস্কারের নানা উদ্যোগের কথা শোনা যায়। অক্সফোর্ড, মডার্না, সিনোভ্যাক, গামালিয়া, বায়ো এনটেকের ভ্যাকসিন ট্রায়ালে সাফল্য পাওয়ার পর বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এতে ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে এক ধরণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো ভ্যাকসিন আবিস্কারক ও উৎপাদক সংস্থাগুলোর সাথে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা প্রাপ্তির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। কোনো দেশই কোনো এক দেশ বা কোম্পানির উপর নির্ভরশীল হয়নি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক বড় সুযোগ হাতছাড়া করে একক দেশ হিসেবে ভারতের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, চুক্তি হওয়া সত্তে¡ও ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে ভারত কালক্ষেপণ ও টালবাহানা শুরু করেছে।
সেরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সরবরাহের উপর ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। এই নিষেধাজ্ঞা যদি দুই দেশের সরকারের সম্মতিতে স্বাক্ষরিত কোম্পানির চুক্তিকে প্রভাবিত বা বিলম্বিত করে, তাহলে তা অনাকাক্সিক্ষত এবং অনভিপ্রেত। বিশেষজ্ঞরা ভারতের এ আচরণকে বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পরিকল্পিত প্রতারণা হিসেবে বিবেচনা করছেন। কারণ, গত বছরের মাঝামাঝিতে চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেকের উদ্ভাবিত টিকার অগ্রাধিকারভিত্তিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে চীনা সরকারের তরফ থেকে শুরুতেই বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। এ প্রস্তাবের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রীংলা জরুরী ভিত্তিতে বাংলাদেশে সফরে এসে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিরাম ইনস্টিটিউটের টিকা সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। এ অনুযায়ী, নভেম্বরের ৫ তারিখ সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে বেক্সিমকো ফার্মার চুক্তি হয়। চুক্তি অনুসারে, তিন কোটি ডোজের মূল্য বাবদ ৬০০ কোটি টাকা অগ্রিম প্রদান করা হলেও প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ সরবরাহ করবে বলে বলা হচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যে প্রথম চালান পৌঁছার কথা থাকলেও নিষেধাজ্ঞার উছিলায় তা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিনের জন্য এক দেশের উপর নির্ভর না করে বহুমুখী প্রচেষ্টা চালালে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। তবে তারা বলছেন, সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি অক্ষুন্ন রেখে অক্সফোর্ড, মডার্না, গ্যামালিয়া ও সিনোভেকের টিকার জন্য জরুরী কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, বাণিজ্যিক অসমতা দূর করাসহ নানা ইস্যুতে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কেবল আশ্বাস ছাড়া কিছুই পায়নি। এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায়ও আশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো কিছু বাস্তবায়ন হয়নি। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের নদী বন্দর, সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর, রাস্তা, নৌ-পথ, রেলপথ ব্যবহার করে প্রায় বিনামূল্যে ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা পেয়েছে ভারত। করোনাভাইরাস মহামারীর সময় চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন সংগ্রহের সুযোগ গ্রহণ না করে ভারতের সাথে চুক্তি করার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে। ভারত ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো তার আশ্বাসের নীত গ্রহণ করেছে। সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরী অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেয়া হবে এবং অগ্রিম টাকা পরিশোধ করার পর ভারতের এ ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে নি¤œস্তরের কোনো কর্মকর্তার সাথে আলাপ-আলোচনা চলতে পারে না। তার আশ্বাসে কোনো কাজ হবে না। বরং টিকা পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে। সুস্পষ্টভাবে টিকার পরিমান এবং পাওয়ার সময় নির্ধারণ করতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক টিকা আনার ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পাদিত ভ্যাকসিনের চুক্তিকে আকস্মিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে স্থগিত রাখার সুযোগ নেই। দেশের ১৬ কোটি মানুষকে এক বছরের মধ্যে করোনা ভ্যাকসিনেশনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য অন্যান্য দেশ থেকে টিকা আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এক দেশ নির্ভর হলে চলবে না। চীনের সিনোভ্যাক, রাশিয়ার গ্যামালিয়াসহ ট্রায়াল ও বাণিজ্যিক উৎপাদনে সফল ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানীগুলোর কাছ থেকে টিকা পাওয়ার জন্য জরুরী ভিত্তিতে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। করোনাভ্যাকসিন নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা দূর করতে দ্রæত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।