তরিকুল ইসলাম : স্মরণে প্রতিক্ষণে

0

অধ্যাপক মোঃ মসিউল আযম
গত ৯ অক্টোবর দুপুরে আমি শহর থেকে সিএনজি যোগে বাড়িতে ফিরছি। হঠাৎ মোবাইলে রিং বেজে উঠে। চলন্ত গভীর শব্দে কিছু ভালোভাবে শোনা যাচ্ছিল না। শুধু বুঝতে পারলাম আমার অতি স্নেহভাজন দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার প্রকাশক শান্তনু ইসলাম সুমিতের কন্ঠস্বর। তার আবদার আগামী ৪ নভেম্বর পত্রিকার ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও আমার পিতার ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে আপনার একটি লেখা চাই। ওর দাবি, ওর আবদার আমার উপেক্ষা করার জো-নেই।
আমি ওদের পরিবারের সদস্য নই। কিন্তু নানা সুবাদে আমার ছিল তাদের বাসায় যাতায়াত। ফলে অমিত ও সুমিত দু’ভাই-ই কৈশোর বয়স থেকে আমাকে চেনে। এছাড়াও জননেতা তরিকুল ইসলাম ছিলেন ষাটের দশকের একজন তুখোড় ছাত্র নেতা। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা। যশোর এম.এম. কলেজেরও একজন বলিষ্ঠ নেতা। আমিও ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য, তাঁর সহচর। অপরদিকে তাঁর শ্বশুর আবদুল হাসিব ছিলেন আমার অগ্রজ সাংবাদিক। তাঁর বাসভবন ছিল পুরাতন কসবা হক মঞ্জিলের সামনে নিরিবিলি এলাকায়। সেখানেও আমার সাংবাদিক হিসেবে বিচরণ ছিল। তাছাড়া আবদুল হাসিবের সুযোগ্য কন্যা নার্গিস বেগমও ছিলেন মাইকেল মধুসূদন কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম সংগঠক। ছাত্র-ছাত্রীদের নেতৃত্বদানে তাঁরও একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি এটি লাভ করেছেন তাঁর পিতার কাছ থেকে। তিনিও একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক অনুসারী ছিলেন। আবার জননেতা তরিকুল ইসলামের সাথে বিয়ের পর শ্বশুর পরিবারও একই পথ ও মতের অনুসারী। ফলে তা ষোলআনায় পূর্ণ হলো। রক্তে অস্থিমজ্জায় হয়ে গেলেন একজন সফল নেত্রী। এখন যশোর জেলার বিএনপি’র আহ্বায়ক হিসেবে তিনি নেতৃত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে, কাজে কর্মে চিন্তা ও চেতনায়।
এবার আমি আসি অন্য প্রসঙ্গে। ১৯৬৬ সালে যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রসংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয় লাভ করে। তখন যশোরে ছাত্রলীগ কর্মী খালি চোখে দেখা যেতো না। হাতে গোনা দু’চারজনের মধ্যে ছিল পুরাতন কসবা এলাকার আনোয়ার চাকলাদার, ষষ্টীতলার আলী তারেক। আনোয়ার চাকলাদার ছিলো আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী। পরবর্তীকালে যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদায় অবসর নেন। ষষ্টীতলাপাড়ার আলী তারেক মন্ত্রী তাজউদ্দিনের (পিএস) হিসেবে অবসর গ্রহণের পর বিদেশে পাড়ি জমান।
এবার আসি ভিন্ন প্রসঙ্গে। ১৯৬৬ সালে আমরা যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ হতে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয় লাভ করি। তরিকুল ইসলাম জিএস নির্বাচিত হন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমি সাহিত্য ও পত্রিকা সম্পাদক, উজির আহমেদ খান বিতর্ক সম্পাদক ও আতাউল হক মল্লিক ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই সময়ে কলেজে ছাত্রদের সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে তৎকালীন এম.এন.এ আহম্মদ আলী সরদারের দায়েরকৃত মামলায় কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র নেতারাও গ্রেফতার হন। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন অধ্যক্ষ আবদুল হাই, অধ্যাপক শরীফ হোসেন, অধ্যাপক গাজী লুৎফর হোসেন, অধ্যাপক তবিবর রহমান ও অধ্যাপক আবু তাহের। ছাত্র নেতাদের মধ্যে ছিলেন তরিকুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ. আমজাদ হোসেন, খালেদুর রহমান টিটো, গোলাম মোস্তফা, এনামুল হক, আসাদুজ্জামান, আবদুল মতিন, জাকারিয়া মিলন ও সিরাজুল ইসলাম বুলবুল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরও ৬/৭ বারের মত ক্ষমতাসীন দলের মামলায় কারাবরণ করতে হয় তরিকুল ইসলামকে। ১৯৭৫ সালের ৭ এপ্রিল বিশেষ ক্ষমতা আইনে আবারও কারাগারে যান। ওই সময়ে একই সাথে তাঁর বন্ধু মাহবুবুর রহমান ও মাষ্টার নূর জালালও আটক হন।
এদিকে এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৩ সালের এপ্রিল মাসে আবারও বিশেষ বাহিনীর হাতে আটকের পর বন্দী থাকাকালে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয় তাঁকে। তথাকথিত এরশাদ হত্যা চেষ্টা মামলায় তাঁকে প্রধান আসামি করা হয়। এ সময় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে তাঁর সাথে ছিলেন আলী রেজা রাজু, অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, অধ্যাপক ইয়াকুব আলী, অধ্যাপক শেখ আবদুল ওহাব, কাজী মুনিরুল হুদা, অ্যাড ইসহক, আবদুস সালাম আজাদ, ইউসুফ আলী, শাহীন, আবু মোর্তজা ছোট, কচি মিনু। ২০০৯ সালের পর তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দল একের পর এক মামলা দায়ের করায়, এমনকি ২০১৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মামলা তাঁর পিছু ছাড়েনি। সকল মামলাই ছিল সাজানো ও মিথ্যা।
এবার আসি আরেকটি প্রসঙ্গে। তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত, বিএনপি’র কর্মী ছিলেন কাশিমপুর ইউনিয়নের আবদুল হাই তরফদার, ১৯৭৮ সালে বিএনপি নামে নতুন দলের জন্ম হয়। জননেতা তরিকুল ইসলামের সাথে আবদুল হাই-এর ছিল খুবই ঘনিষ্ঠতা। তিনি জিয়াউর রহমানের ডাকে ঢাকায় বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে কাশিমপুর ইউনিয়ন থেকে একাই যোগদান করেন। পরে এটি জানতে পেরে একটি মহল তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হন। তাঁরা ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের বাড়ি থেকে ইট সংগ্রহ করে চুড়ামনকাটি বাজারে হাই তরফদারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয়তাবাদী দলের সাইন বোর্ড ইটের আঘাতে ভেঙে ফেলে। তিনি পরদিন সকালে গিয়ে দেখেন ইটের স্তুপে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঘর বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি পরে শ্রমিক দিয়ে সেই ইট সরান। আবদুল হাই তরফদারের বড় ছেলে আমারই কলেজের প্রাঙ্গন ছাত্র সাংবাদিক ফটোগ্রাফার ওয়াহিদুজ্জামান মিলন এই চমকপ্রদ ঘটনাটি জানায়। এটি তার নিজ চোখে দেখা।
আরেক দিনের ঘটনা তরিকুল ইসলাম তখন তথ্যমন্ত্রী ছিলেন। একদিন সকালে জাতীয় পত্রিকায় একটি খবর পড়ে তিনি জানতে পারেন বাজারে ফুলকপি উঠেছে। খেতে খুব ইচ্ছে করছে। সাথে সাথে কাছের মানুষ আবদুল হাই তরফদারের কাছে সকালেই ফোন। আজকে জাতীয় পত্রিকা দেখেছিস, তা পড়েছিস ? বাজারে নাকি নতুন ফুলকপি উঠেছে। আবদুল হাই জানালেন- জি¦ ভাই দেখেছি। ঘন্টাখানেক বাদেই মন্ত্রীর গাড়ি এসে সোজা হাজির তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। বিভিন্ন মাঠ ঘুরে ফুলকপি সংগ্রহ করে তাঁকে পাঠানো হয়। আর শীত মৌসুম এলে খেঁজুর গাছের সন্ধ্যা রস খাওয়া ছিল আরেক শখ। এসব সংগ্রহের পর জগ ভর্তি করে ছুটতেন শহরে মন্ত্রীর বাসভবনের দিকে। কেন না তাঁর নেতা রস খেতে চেয়েছেন। আবদুল হাই জীবদ্দশায় বিএনপি’র একজন ত্যাগী নেতা হিসেবে দলের সদস্য ও কর্মী সংগ্রহের কাজে কখনও সাইকেলযোগে, কখনও পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন গ্রামে গ্রামে, পাড়া মহল্লায়।
এবার আমি স্মৃতিচারণমূলক লেখায় ফিরে আসি। যা খুব কাছ থেকে দেখা। সেই ষাটের দশক থেকে। সবই একটি জীবন্ত ইতিহাস। আমার বড় মেয়ে হোসনে আরা নূপুর তখন যশোর মোমিন গার্লস স্কুলের ছাত্রী। তরিকুল ইসলামের ছেলে সুমিত দাউদ পাবলিক স্কুলের ছাত্র। তারা প্রাইভেট পড়তো মোমিন গার্লস স্কুলের খ্যাতিমান শিক্ষক আবদুল ওহাব স্যারের কাছে।
১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাকে যশোর জেলা শার্শা থানায় উলাশী যদুনাথপুর খাল খননে তরিকুল ইসলাম আমাদের কলেজের ছাত্রদের অংশগ্রহণ করতে কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানান। খালখননে মাটি কেটে কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ রেকর্ড স্থাপন করে। এর সূত্র ধরে তদানীন্তন জেলা প্রশাসক মহিউদ্দিন খান আলমগীর কলেজের ছাত্র শরীফুল ইসলামকে মোবারকগঞ্জ সুগার মিলে চাকুরির ব্যবস্থা করেন। পরদিন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সড়ক পথে কুষ্টিয়া যাবেন। আমরা তরিকুল ইসলামকে জানালাম প্রেসিডেন্টকে আমাদের কলেজের সামনে তার গাড়ি বহরকে থামাতে হবে। প্রেসিডেন্টের গাড়ি ইচ্ছা করলেই থামানো যায় না। আমাদের তরিকুল ইসলাম প্রেসিডেন্টকে জানালে তিনি হ্যান্ডমাইকে অপেক্ষমাণ ছাত্র জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। তরিকুল ইসলাম তখন বাংলাদেশ সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। কলেজের দুইতলা বিজ্ঞান ভবন নির্মাণে তাঁর অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে হয়। নার্গিস বেগম কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য থাকাকালীন কলেজের উন্নয়নে অনেক সুপরামর্শ ও ভূমিকা রেখেছেন।
১৯৭৯ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি এলাকার মানুষ এখনও ভোলেননি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন দূরবর্তী এলাকার ভোটারদের আনার জন্যে একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করা হয়। তরিকুল ইসলাম ছিলেন সেই নির্বাচনের একজন প্রার্থী। ভোটারদের বহনকারী ট্রাকটি চুড়ামনকাটি হাইস্কুল ভোট কেন্দ্রের অনতিদূরে মেহেরুল্লানগর রেলস্টেশন ক্রসিং পার হওয়ার সময় হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় ঠিক ওই মুহূর্তে খুলনা থেকে রাজশাহীগামী ট্রেনের ধাক্কায় ট্রাকটি উল্টে যায়। চালক দ্রুতগামী মেল ট্রেনের বাঁশি বাজালেও তাতে কাজ হয়নি। দুইজন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ছাতিয়ানতলা গ্রামের জহুরুল আজিজের ছেলে যশোর এমএম কলেজের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র রওশন আজিজ, দোগাছিয়া গ্রামের খোরশেদ আলীর ছেলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আবদুল হক। দুর্ঘটনায় ৫/৬ জন আহত হয়। আমার ছোট ভাই শাহিকুল আজম প্রার্থীর একজন কর্মী হিসেবে ভোটারদের বহনের কাজে নিয়োজিত ছিল। দুর্ঘটনার খবর পাওয়া মাত্র তরিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি বলেন, আমার ভোটের দরকার নেই। আহতদের বাঁচান। চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব ও ব্যয়ভার তিনি নিজে বহন করেন। আহত, নিহত ও শোকাহত পরিবারের পাশে দাঁড়ান, ছুটে যান তাদের বাড়িতে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাদের পাশে ছিলেন।
১৯৯৪ সাল। তিনি তখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহর ১৩৩তম জন্মবার্ষিকীতে তিনি ঝাউদিয়া মুন্সী মেহেরুল্লাহ একাডেমিতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। ওই বছরই ঝাউদিয়া মেহেরুল্লাহ একাডেমি হতে ছাতিয়ানতলা মুনশী মেহেরুল্লাহর মাজার পর্যন্ত রাস্তা পাকাকরণের ব্যবস্থা করেন।
পরবর্তী বছর ১৯৯৫ সালে কর্মবীরের ৮৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৮ জুন এই মহান ব্যক্তির স্মরণে বাংলাদেশ টেলিভিশন একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আলোচক হিসেবে তরিকুল ইসলাম, ডঃ শমসের আলী, অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ুমসহ আমারও অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনিবার্যকারণবশত: তিনদিন আগে আমাকে যশোরে ফিরে আসতে হয়। কেননা ঢাকা টেলিভিশন থেকে কবি আবদুল হাই শিকদারের নেতৃত্বে মেহেরুল্লাহর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ টিভিতে ধারণ করা হবে। আমাকে এর আগে থেকে সার্বিক প্রস্তুতি ও যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। অবশেষে তরিকুল ইসলাম সেদিন অনুষ্ঠানের পূর্বেই স্মারক খাম সংশ্লিষ্ট মহলে পৌঁছে দিতে বলেন। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেদিন স্মারক ডাক টিকেটের উদ্বোধন করেন।
আবদুল হাই শিকদার এর আগে আমাকে নিয়ে কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহের চিত্র ধারণ করেন। মেহেরুল্লাহর পরিবারের ও আমার সাক্ষাতকার টিভিতে প্রচার করা হয়। তাঁকে সঠিক সহযোগিতা দানের জন্যে এর উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত বইয়ে আমার নামটি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করেন।
এ সময় তিনি চুড়ামনকাটি এলাকার জনসাধারণের সুবিধার্থে ইউনিয়ন পরিষদ ও পোষ্ট অফিস সংলগ্ন একটি কার্ড ফোন বুথ স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। মাত্র ৫ টাকার কয়েন ফেললেই টেলিফোনে কথা বলা যেতো।
১৯৬৭ সালে ডিফেন্স অব পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইনে এমএম কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল হাই, শরীফ হোসেনসহ ৮/১০ জন শিক্ষক ও ছাত্রনেতা তরিকুল ইসলামসহ ১০/১৫ জন ছাত্র গ্রেফতার হন। আমি তখন ছাত্র সংসদের পত্রিকা সম্পাদক। তরিকুল ইসলাম যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আমাকে একটি চিরকুট লিখে পাঠান। ছাত্র সংসদকে চলমান রাখতে হবে। এতে যেন কোন শিথিলতা না আসে। এই চিঠি পাওয়ার পরই আমি অনেকটা সাহস ও অনুপ্রেরণা লাভ করি। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে বার্ষিক ম্যাগাজিন ছাপার জন্য পূর্বাচল প্রেসের মালিক ফজলুল বারীর শরণাপন্ন হই। প্রেসের ম্যানেজার আবদুল মান্নান আমাকে প্রস্তাব দেন বার্ষিকী ছাপার জন্যে বরাদ্দকৃত এত বেশি টাকা ব্যয় না করে আপনি কিছু রেখে দেন। আমি তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। সম্পূর্ণ টাকা এর পেছনে ব্যয় করি। ২৬৭ পৃষ্ঠার এই বৃহৎ ম্যাগাজিন ইতিপূর্বে কোনদিন কলেজের ইতিহাসে বের হয়নি। এটি সম্ভব হয়েছিল তরিকুল ইসলামের ছোট একটি চিরকূটের কারণেই। কলেজের কাজ নিয়ে মাঝে মাঝে ঢাকায় যেতে হতো। আমি সোজা চলে যেতাম ঢাকা মিন্টো রোডে মন্ত্রীপাড়ায় তরিকুল ইসলামের বাসভবনে। সকাল নয়টার আগেই আমি পৌঁছে যেতাম। মন্ত্রীর একান্ত সচিব আবদুল হাফিজ আমাকে সোজা তাঁর বেডরুমে নিয়ে বসাতেন। অনেকেরই বেডরুমে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। আমি মন্ত্রীর গাড়িতেই সচিবালয়ে ঢুকে বিভিন্ন কাজ শেষে যখন বেরুতাম তখন সচিবালয়ে অপেক্ষাগারে সাক্ষাত প্রার্থীদের দীর্ঘ লাইন।
১৯৯৯ সাল। আরেকটি ঘটনার কথা বর্ণনা না করে পারছি না। বিএনপি সরকার তখন ক্ষমতায়। আমি তখন যশোর জেলা বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি। কাজী শওকত শাহী সম্পাদক। শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা, দাবি ও অধিকার আন্দোলনে আমরা তখন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বন্ধ করে রাজপথে নামি। আমাদের দাবির প্রতি সরকার হতে কোন সাড়া পাচ্ছিলাম না। যশোরের শিক্ষক সমাজ ফেডারেশন হতে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের কাছের মানুষ তরিকুল ইসলামকে আমাদের দাবির বিষয়টি বোঝাতে হবে। যশোর মুসলিম একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাই। তিনি আমাদের ডাকে সাড়া দেন। তিনি ধৈর্য্য সহকারে সব শোনেন। কথা দেন দাবিগুলি সরকারের কাছে তুলে ধরবেন। অথচ আমরা তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। একমাত্র তরিকুল ইসলামের মত উদার হৃদয়ের মানুষের পক্ষে সেটি সম্ভব। আমরা সফল হয়েছিলাম। সরকার হতে কিছু আর্থিক সুবিধা লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলাম। ওই সময়ে তিনি ব্যক্তিগত তহবিল হতে ২৫ হাজার টাকা অনুদান হিসেবে শিক্ষক সমিতির হাতে তুলে দেন।
২০০৩ সাল। আমি তখন কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। কলেজে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমরা তরিকুল ইসলামকে আমন্ত্রণ জানাই। অনুষ্ঠানস্থলে মঞ্চে মন্ত্রীর আসনের পাশেই আসন গ্রহণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল বারী। ওই বিষয়টি তখন সকল মহলে মুখরোচক আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় তোলে। তাহলে আবদুল বারী দল ত্যাগ করে বিএনপিতে যাচ্ছেন। ওই অন্ষ্ঠুানে তিনি তরিকুল ইসলামের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, তরিকুল ইসলাম শুধু যশোরের মন্ত্রী নন দেশেরও মন্ত্রী। ফলে তাঁর পাশে বসা যায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন এক আলাদা জগতের মানুষ। খাঁটি পরীক্ষিত এক রাজনীতিবিদ।
১৯৯৬ সাল। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যশোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যশোরে আসবেন। তাঁর আগমণ উপলক্ষে তিনি মহাব্যস্ত। এর মাঝে আগের দিন রাতে সাংবাদিক হারুন জামিলের কাছে জানতে চান, মসিউল আযম অনুষ্ঠানের দাওয়া পেয়েছে কি না ? শত ব্যস্ততার মাঝে তা কীভাবে সম্ভব ? এটি একমাত্র তরিকুল ইসলামের পক্ষেই শোভা পায়।
তাঁর অফিসে বাসায় কোন সাহায্য সহযোগিতা প্রার্থী হয়ে সাক্ষাত করলে কখনও কেউ খালি হাতে বিফল মনোরথ হয়ে ফেরেননি। দলমত নির্বিশেষে এমনকি পিয়ন, মালী, আয়া, পরিচ্ছন্নকর্মী নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে ফোনে সুপারিশ করেছেন। তিনি বলতেন এরা কোথায় যাবে ? আমার কাছে তাঁরা বড় আশা নিয়ে এসেছেন। পরিশেষে আমি বলতে চাই তরিকুল ইসলামের মত প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষণ, জনদরদী নেতা এদেশে বারবার জন্মে না। একবারই জন্মে।
[লেখক মোঃ মসিউল আযম প্রবীণ সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী]