নির্বাচনের অধঃগতির দায় ইসিকেও নিতে হবে

0

সালাহউদ্দিন বাবর
তার বেলা ও শেষ খেলাও সাঙ্গ হতে চলেছে; কিন্তু খেলতে নেমে এত রেড কার্ড পাওয়া দেশের আর কোনো প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাগ্যে জোটেনি। তবে এটা ভাবতে অবাক লাগে যে, এই ‘রেড কার্ড’ পাওয়া খেলোয়াড়, এ জন্য এতটুকু শর্মিন্দা নন বা কোনো ধরনের গ্লানিতে ভোগেন না বোধ করি; বরং মনে করেন তিনি দশ নম্বর খচিত জার্সি পরা এক পাকা খেলোয়াড়। প্রতিপক্ষের জালে এত বল শুট করে গোল রক্ষককে পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছেন, তাই বেস্ট প্লেয়ারের অ্যাওয়ার্ড তার হাতেই শোভা পাবে। নির্বাচন কমিশনের ক্যাপটেন হিসেবে অতীতের সব ক্যাপটেনের চেয়ে তিনি বেস্ট পারফর্ম করেছেন, ইতিহাস তাকে যুগে যুগে স্মরণ করবে! তিনি এমন জাদুকরী খেলা খেলেছেন, দিবালোকে নয়, রাতে নির্বাচন করিয়ে দেখিয়েছেন তিনি এতটাই পারঙ্গম যে, রাতকে দিন বানিয়ে বিখ্যাত জাদুকর পিসি সরকারও তার কাছে নস্যি। বিশ্বকে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন যে, নির্বাচনের জন্য ভোটারের প্রয়োজন হয় না, দরকার হয় প্রজাতন্ত্রের কিছু করিৎকর্মা কর্মচারীর যারা সজোরে শত কণ্ঠে ¯স্লোগান দিতে পারেন ‘সিল মারো ভাই, সিল মারো’।
তাদের প্রটেকশন দেয়, বিরিয়ানির প্যাকেট পাওয়া কিছু সিপাহি সান্ত্রী যাতে কোনো আম জনতা ভোট কেন্দ্রে এসে কেরামতির নির্বাচনে কোনো গোল বাধাতে না পারে। সেই ‘বেস্ট পারফর্মার’ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। তার আমলের এখন শেষ নির্বাচন হচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদগুলো। আমলের শেষ নির্বাচন তাও আর এক রেকর্ড সৃষ্টিকারী। এ পর্যন্ত বহু ইউপি চেয়ারম্যান সদ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত ঘোষিত হয়েছেন। সম্ভবত কোনো প্রার্থী এমন ‘ফার্ম’ নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী হননি বলেই সবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বিজয়ী হন; এ পর্যন্ত যতগুলো ইউপি নির্বাচন হয়েছে তার প্রায় সব কটিতে হুড়হাঙ্গামা সংঘর্ষ, সঙ্ঘাত, ছয় শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। কোথাও নির্বাচন অনুষ্ঠানের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকেনি। এবারের ইউপি নির্বাচনে এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যান পদে ৩৫৪ জন, ওয়ার্ড সদস্য পদে ৮৫৮ জন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য ৩৩৪ জন বিজয়ী হয়েছেন সব মিলিয়ে এক হাজার ৫৭৬ জন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। এভাবে সাঙ্গ হতে চলেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তার সাথীদের বেলা। বাংলাদেশের মানুষ এমন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ হরেক কিসিমের নির্বাচন দেখার অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার অধিকার হিসেবে ‘গিনেস বুকে’ নাম তোলার সুযোগ পেয়ে যাবেন। যেসব নির্বাচনের স্বরূপ ছিল; ভোটারবিহীন নির্বাচন, ‘সিল মারো ভাই সিল মারো’ এর নির্বাচন, ‘হ্যাঁ, না’-এর ভোট, নির্বাচনে পপুলার রিগিং’ আবার ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে ভোঁ-দৌড়, যেন দিগন্ত ছোঁয়ার এক প্রতিযোগিতা। কোনো দেশে নির্বাচন নিয়ে এমন ‘খেল তামাশা’ হয় বলে শুনিনি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র যার প্রাণস্বরূপ হচ্ছে নির্বাচন তা নিয়ে যত রং তামাশা হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বহির্বিশ্বে আলোচনা সমালোচনার ঢেউ হয়েছে। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল, ব্যক্তি বিশেষ, তথা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটের চেতনা সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা সযতনে রক্ষা করেন। আর ভোট পরিচালনাকারী সরকারি সংস্থা ব্যতিব্যস্ত থাকেন ভোটাররা কতটা স্বচ্ছন্দে নিরাপত্তার বেষ্টনীতে থেকে মুক্ত পরিবেশে উৎসবের আমেজ, উৎফুল্ল চিত্তে ভোট দিতে পারেন। নির্বাচনের আয়োজকগণ ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারাকে ভাবেন বলেই নিজেদের কর্তৃত্ব বলে মনে করেন বরং তা তাদের না দায়িত্ব।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা তেমনভাবে সেসব বিষয় বিবেচনায় নেন না। তাদের মধ্যে এমন বোধ জাগ্রত থাকার দীক্ষা দেয়া হয়নি যে, তারা মহান কাজের ভার নিজ স্কন্ধে নিয়েছে দেশের গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা ও মানুষের ভোটাধিকারকে সংরক্ষণ করার। আগে উল্লেখ করেছি, দেশে সব ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে যাই ঘটুক, তা নেতিবাচক বা ইতিবাচকই হোক; দেশী-বিদেশী নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তি ও সংস্থা তার সবই লক্ষ করেন, রেকর্ড রাখেন। নির্বাচন কিভাবে হচ্ছে তার প্রকৃতি, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনের স্বরূপ, নির্বাচনে কতটা বাধাহীনভাবে ভোট-ব্যবস্থা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন ইত্যাদি। নির্বাচন-স্বরূপ সম্পর্কে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের সব প্রতিবেদন, ঢাকায় দায়িত্ব পালনরত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের নির্বাচনসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ-এসব উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক ও নির্মোহ রিপোর্ট তৈরি করা হয়। পশ্চিমের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র; নির্বাচন, মনিটরিংকারী আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা তাদের নির্বাচনসংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয় নিয়ে যে রিপোর্ট তারা তৈরি করে, সেখানে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে একপেশে ভূমিকা, নির্বাচনে সংঘটিত যত অনিয়ম অব্যবস্থা ভোটারদের নিরাপত্তা সম্পর্কে কমিশনে নির্লিপ্ততার বিষয় অবজারভেশনে উঠে আসে সেই সবই প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক অধ্যায়ই সংযোজিত হয় যা কি না দেশের ভাবমর্যাদাকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ করছে, যার আভাষ ইঙ্গিত যথেষ্ট হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্মেলনে কয়েকটি দেশসহ বাংলাদেশের আমন্ত্রণ না পাওয়া। নিকট অতীতের এবং সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে যত অনিয়ম, বিপত্তি, হানাহানি সংঘর্ষ সঙ্ঘাত ও প্রাণহানি ঘটেছে, তা দেশের ভাবমর্যাদার বিরাট ক্ষতি করছে। ইসির সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের ফলে নেতিবাচক ইমেজ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের যে কটি সাধারণ নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ হয়েছে এবং ভোটাররা অপেক্ষাকৃত নিরাপদে ভোট দিতে পেরেছে, তার ভেতর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অন্যতম। তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকারের আমলে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সে সময় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করেছিলেন। ৯১ সালের পঞ্চম সংসদের নির্বাচনের দিন তারিখ নির্ধারণ হয়ে যাওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার কার্যালয়ে সব জেলার ডিসি ও এসপিদের এক সম্মেলনে আহ্বান করেছিলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি রউফ সে সভায় বক্তৃতাকালে বলেছিলেন, আমরা বিচারপতিরা বিচারকার্য পরিচালনার সময় যিনি সন্দেহাতীতভাবে দোষী প্রমাণিত হয়, তাকে বিনা দ্বিধায় আইনানুগভাবে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে এতটুকু কুণ্ঠা বোধ করি না। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে যে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তিনি যে পদমর্যাদারই হোন না কেন, যদি জ্ঞাতসারে নির্বাচন কার্যে কোনো দল বা ব্যক্তির প্রতি অনুকম্পা অনুরাগ প্রদর্শন করেন, নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকালে অনিয়ম অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন, আর তা যদি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, তবে তার বিরুদ্ধে আইনের বিধান মোতাবেক যা শাস্তি সাব্যস্ত হয়, তা দিতে কমিশন এতটুকু দ্বিধা বা বিলম্ব করবে না। সংবিধান সে ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছে। দেশের সংবিধান যে, সর্বোচ্চমানের নির্বাচন কামনা করেন, বিচারপতি রউফের সেই বক্তব্যের ছত্রে ছত্রে সেটি পরিস্ফুট হয়েছে। এটাই সব সময় কমিশনের বিবেচনায় থাকা উচিত ছিল।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার যে অধঃগতি হয়েছে, তাতে যার যতটুকু ভ‚মিকাই থাকুক। দেশের সে সময় ক্ষমতায় থাকা সরকার এবং দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনের ভ‚মিকা এ জন্য দায়ী। তা কেউই অস্বীকার অগ্রাহ্য করতে পারবে না। যে কারণে দেশের গণতন্ত্র আজ অবধি এতটা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। সেই সাথে জনগণের ভোটাধিকার সম্পর্কিত সংবিধানের কানুনগুলো রক্ষিত হয়নি। এর দায় থেকে অতীত থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সরকার ও নির্বাচন কমিশন মুক্ত হতে পারবেন না। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, সরকারের মন্ত্রীরা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার দায়িত্ব গ্রহণের প্রাককালে সবাই এই মর্মে শপথ গ্রহণ করেন তারা ‘সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান’ করবেন। এমন প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক, তারা সবাই কি সেই পবিত্র শপথের মর্যাদা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন? দেশের সংবিধান যে উচ্চমানের ও প্রশ্ন বিমুক্ত নির্বাচন কামনা করে, মানুষের ভোটাধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করার মতো নির্বাচন কমিশন যাতে সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে। সেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব রকম আইনি ক্ষমতা কমিশনকে দেয়া হয়েছে। অতীত থেকে আজ অবধি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে কোনো ইসি সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে নির্বাচনকে স্বচ্ছ সুষ্ঠু করার জন্য স্বীয় উপযুক্ততা, সক্ষমতা, নিরপেক্ষতা সপ্রমাণ করতে পারেননি বরং এমন বহু উদাহরণ আছে। দল বিশেষের প্রার্থীর প্রতি তাদের অনুরাগ পক্ষপাতিত্ব; সেই প্রার্থীর সব অনিয়ম বেআইনি কাজ চোখ বুজে সয়েছেন। তাই এ কথাও নির্দ্বিধায় বলা যায় গণতন্ত্রের প্রতি তাদের নিষ্ঠা প্রতিশ্রæতি কতটুকু তা নিয়ে গভীর সংশয়ের সৃষ্টি হয়ে আছে। অবশ্য এর কারণ রয়েছে; তা তুলে ধরা হবে। এখন বলতে চাই: গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে যেসব নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি অনুসন্ধান গবেষণা করেন, তাদের অভিমত, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব করার যে ব্যবস্থা রেখেছে তা অতুলনীয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, তাদের নির্বাচন কমিশনকে যতটুকু কর্তৃত্ব ক্ষমতা তাদের সংবিধান দিয়েছে, তুলনামূলকভাবে তা বাংলাদেশের কমিশনের চেয়ে কম। কিন্তু ভারতের কমিশন প্রাপ্ত ক্ষমতা বলেই ভারতকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এর অন্যতম কারণ সে দেশে কমিশনের গঠন সংক্রান্ত আইন থাকা। যার ফলে একমাত্র সৎ যোগ্য দক্ষ করিৎকর্মা ব্যক্তিদের কমিশনে আসার সুযোগ হয়েছে। কমিশনের সেই সব যোগ্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সদস্যরা অনুরাগ বিরাগ ও রাজনৈতিক চাপের ঊর্ধ্বে থেকে রাজনৈতিক দল, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থী, কোটি কোটি ভোটার আর নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের নির্বাচনকে নির্ভেজাল অর্থপূর্ণ করা এবং গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য আইনের ধাঁচে ফেলে দীক্ষা দিয়েছেন। ফলে সেখানে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন ওঠে না। বিরাট আয়তনের দেশ ভারত, যেখানে শত কোটিরও বেশি মানুষের বাস, হাজারের বেশি জীবন্ত ভাষা, শত মত পথের ও নৃগোষ্ঠীর নাগরিক নির্বিশেষে সবাইকে গণতান্ত্রিক সময়, শিষ্টাচার বুঝতে মানতে শিখিয়েছে ভারতের নির্বাচন কমিশন। ভারতের কমিশনকে যে শক্তি তাদের সংবিধান ও নির্বাচনী বিধি বিধান দিয়েছে তা পুরোপুরি যোগ্যতার প্রয়োগ করে নির্বাচনকে বিশুদ্ধতা উচ্চপর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। সেই কমিশনের সদস্যদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, গণতন্ত্রের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা তো ছিলই। এসব থেকে আমাদের ইসির বহু কিছু দীক্ষা নেয়ার আছে।
আমাদের কমিশনের দুর্বলতা কোথায় তা পরে বলব বলে ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে এর মূলে রয়েছে, নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায়। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ দান করিবেন।’ কিন্তু সংবিধানের বর্ণিত নির্বাচন কমিশনের গঠন করা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বিধান তৈরি করা হয়নি বলে, সব সময় নির্বাচন কমিশনের গঠন নিয়ে তিক্ত বিতর্কের জন্ম হয় যা এখন চলছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, কমিশন গঠন সংক্রান্ত বিধান তৈরির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও বিগত ৫০ বছরে কোনো সরকারই তা প্রণয়ন করতে আগ্রহী হয়নি। কারণ এর সাথে রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। এখন পর্যন্ত যে প্রক্রিয়ায় কমিশন গঠিত হয়ে থাকে, পরবর্তী ত্রয়োদশ কমিশন সেভাবেই গঠিত হতে চলেছে। সেই প্রক্রিয়ায় যে কমিশন গঠিত হয়ে থাকে, যখন যারাই সরকারে থাকেন, তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়েছেন কমিশন গঠন করার পুরোপুরি সুযোগ তাদের হাতে থাকে। ফলে গঠিত কমিশনে সরকারের অভিপ্রায় অনুসারেই নির্বাচন করার কৌশল আঁটা হয়।
সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করার আইনটি কেন অপরিহার্য, তা ভারতের কমিশনের ভ‚মিকা থেকে খানিকটা উপলব্ধি করা সম্ভব। দেশের সংবিধান যে উচ্চমানের নির্বাচন আশা করে তা তখনই সম্ভব হবে যখন আইনের দ্বারা কমিশন গঠিত হবে। আইনকে ধরে নিতে হবে জনগণের কল্যাণের নিমিত্তেই রচিত। এ দেশ গঠন করার পেছনে যে গণ আকাক্সক্ষা ছিল তার অন্যতম ছিল গণতন্ত্র। সে আশা পূরণের জন্যই তো সংবিধানে যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে। একথা ভুলে গেলে চলবে না, ব্যক্তি ক্ষণস্থায়ী; দেশ অনন্তকাল থাকবে। তাই দেশের স্বার্থটাই সবার কাছে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। আইনানুযায়ী যদি কমিশন গঠিত হয়, সে আইনে তো কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া পদ্ধতি থাকবেই সেই সাথে কমিশনে সদস্য হওয়ার যোগ্যতার বিষয়টি বিশেষ প্রাধান্য পাবেই। এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা, কাঁটাযুক্ত মান্দারগাছ রোপণ করে কেউ উৎকৃষ্ট কাঠ পাওয়ার আশা করতে পারে না। তবে দেশের যে পরিস্থিতি তাতে খুব সহসা নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত আইন তৈরি হবে, তা ভাবা বাতুলতামাত্র। যদিও প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশ-এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত বিধি প্রণয়ন ও জারির ক্ষমতা রাখেন; কিন্তু তা আদৌ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কেননা এতে সরকারে অভিপ্রায় পূরণ হবে না; কিন্তু তা সম্ভব মনে হয় না। এটাই সবার জানা যে, বহু আগে থেকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে যে প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করা হচ্ছে, সেটি হলো, একটা সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনের অন্যান্য সদস্যের নিয়োগ দান করেন। তবে তার আগে রাষ্ট্রপতি নিবন্ধনকৃত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করেন। এবার গত ২০ ডিসেম্বর থেকে এমন সংলাপ শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সংলাপের সময় তাদের কথা শুনবেন এবং সম্ভবত নির্বাচন কমিশনের সদস্য হওয়ার যোগ্য এমন ব্যক্তিদের একটা তালিকা তাদের কাছে চাইবেন। নিবন্ধনকৃত ৩৯টি দলের সাথে সংলাপ শেষে দলগুলো যে তালিকা দেবে সেটি রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে সার্চ কমিটির কাছে যাবে। কমিটি সেই তালিকা থেকে বাছাই করে একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা পুনরায় রাষ্ট্রপতির দফতরে পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি সেই তালিকা থেকে তার বিবেচনায় যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পরবর্তী ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করবেন। গেল এক দশকে সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান ২০১২ সালে এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে সর্বশেষ ১১ ও ১২তম নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ দান করেছিলেন। বলা দরকার, রাষ্ট্রপতি যে সার্চ কমিটি গঠন করবেন সাধারণত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষকসহ দুই-তিনজন সিনিয়র সম্মানিত সিটিজেন সেই কমিটিতে থাকবেন। স্মরণ করা যেতে পারে, বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গঠনের আগে ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির সাথেও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংলাপ শুরু করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদ। এক মাস ধরে ৩১টি দলের সাথে অনুষ্ঠিত সেই সংলাপ ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি শেষ হয়। এর আগে (২০১২ ও ২০১৭ সালে) মূলত আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরিক দলগুলোর পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়েই নির্বাচন কমিশন কমিশন গঠন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান কমিশনে পাঁচ সদস্যের মধ্যে ১৪ দলের শরিক তরিকত ফেডারেশনের তালিকা থেকে তিনজনকে নেয়া হয়েছিল। তারা হলেন- সিইসি নুরুল হুদা, মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী। এখানে একটা প্রশ্ন ওঠা তো স্বাভাবিক যে, রাজনৈতিক দলগুলো যে তালিকা পেশ করবে তার সদস্যগণ কি দল নিরপেক্ষ হবেন? অতীতে তা হয়নি।
একটি বিষয় স্মরণ রাখা উচিত, বিগত দিনে সার্চ কমিটির মাধ্যমে অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত দু’টি কমিশনকে (রকিবউদ্দিন কমিশন ও নুরুল হুদা কমিশন) দেশবাসী দেখেছে। উভয় কমিশনের সদস্যদের চরম পক্ষপাতদুষ্ট ভ‚মিকার ফলে নির্বাচনপ্রক্রিয়া দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উভয় কমিশনের ভূমিকায় নীতি নৈতিকতার চরম স্খলন লক্ষ করা গেছে। সর্বশেষ, নূরুল হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে ভয়ানক দুর্নীতি অভিযোগও উঠেছে। সরকার এই দুই কমিশনে সব অপকর্ম কি আড়াল করে রাখতে পারবেন? সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে কমিশন গঠিত হবে তাদের যোগ্যতা দক্ষতা ও নীতি নৈতিকতা নিয়ে কেউ কি গ্যারান্টি দিতে পারবেন? যদি না পারা যায় তবে এ দেশের গণতন্ত্রে ভাগ্যাকাশ থেকে কালো মেঘ সরানো আদৌ সম্ভব হবে না। আমরা কি ভুলে যাবো বঙ্গবন্ধুর নির্ভেজাল গণতন্ত্রের যে স্বপ্ন দেখেছেন তার স্বরূপটা সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ উপ-অনুচ্ছেদ প্রতিভাত হয়ে আছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধি প্রণয়নের কথা সেখানে আছে। তার উত্তরসূরিরা সে কথা মনে রেখেছেন কি? সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন গঠন করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা সহজ এবং সংবিধান অনুসারেই তা করা যাবে। শুধু আজ নয়; কমিশন গঠনসংক্রান্ত আইন না হওয়া পর্যন্ত সার্চ কমিটির মাধ্যমেই ইসি গঠিত হতে থাকবে। আমাদের সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুধু প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দান ভিন্ন রাষ্ট্রপতিকে আর সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। নির্বাচন কমিশন গঠন করা তথা এর সদস্যদের নিয়োগদানের ক্ষেত্রে তাই রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ গ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপি ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আহূত সংলাপে যোগ দেবে কি না দলে উচ্চতর আলোচনা করবে। তারা আরো বলেছে, ভবিষ্যতে কোনো দলীয় সরকারের অধীনেও তারা নির্বাচনে যাবে না। কোন ব্যবস্থায় নির্বাচনে যাবে তা পরিষ্কার না করলেও, ধারণা যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারই দাবি তারা করবে সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের প্রশ্ন এসে যাবে। এ বিষয়ে সরকার তথা আওয়ামী লীগ রাজি হবে বলে মনে হয় না। তাই সহজেই অনুমান করা যায় পরবর্তী সংসদ নির্বাচন নিয়ে এই মুহূর্তে সঙ্কট সৃষ্টির সম্ভাবনা লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন এখনো অনেক দূরে, ২০২৩ সালে। এর মধ্যে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা কারো পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব নয়। সে যাক, দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ এখন তাকিয়ে আছে নির্বাচন কমিশন গঠনের দিকে। তা ছাড়া কমিশন গঠনসংক্রান্ত আইন তৈরির যে দাবি উঠেছে সে দিকে। এই দুই বিষয় রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সংবিধান যে মানের দাবি করে, সেটি কার্যকর করতে হলে অবশ্যই শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন অপরিহার্য। নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর দেশের মানুষের আস্থা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। সবাই মনে করে, জাতির যে প্রত্যাশা তা পূর্ণ করার জন্য অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে এবং সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।