লিটনের ‘দায়মুক্তি’ ও মুশফিকে রঙিন দিন

0

ইয়াসিন হাসান॥ প্রথমবার সাদা পোশাকে তাকে মাঠে নামতে দেখে নাজমুল আবেদীন ফাহিম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, ‘এই আসছে আমাদের তারকা।’ ভারতের সেরা একাদশের বোলারদের বিপক্ষে ৪৫ বলে ৪৪ রানের ইনিংসের পর সেকালের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফির ঘোষণা ছিল, ‘ওকে ওর মতো করে খেলতে দিন। ১০ বছর বাংলাদেশকে সার্ভিস দেবে।’ নাজমুল আবেদীন ও মাশরাফির বুক ভরা বিশ্বাস জন্মেছিল তার সাহস, টেকনিক ও সামর্থ্য জেনে। তারা ভুল করেননি। তবে লিটন দাশ পারেননি প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যাশার মেলবন্ধন করতে। সেজন্য এলোমেলো হাওয়ায় হারিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে। আর অধারাবাহিক হওয়ায় বাদ পড়তে হয় সীমিত পরিসরের দল থেকে। তবে সাদা পোশাকে তার জায়গা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। এই যেমন, এ বছর উইকেট কিপার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গড় তারই। কিন্তু বিরুদ্ধ সময় তো ফরম্যাট চেনে না! ২২ গজ রাঙাতে তাই তীর্থের কাক হয়ে উঠেন তিনি। যে করেই হোক পরবর্তী সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদে সেই দিনটি পেয়ে গেলেন। এর আগে দুবার সেঞ্চুরির কাছে গিয়েও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। ৯৪ ও ৯৫ রানে আটকে যান।
আজ কোনো ভুল নয়। তিন অঙ্কের ম্যাজিকাল ফিগারে ‘দায়মুক্ত’ হলেন। সঙ্গে মুশফিকুর রহিম ৮২ রান করে ঝকঝকে একটি দিন কাটান। দুজনের আঁটসাঁট ব্যাটিংয়ে সাগর পাড়ের স্টেডিয়ামে জোনাকির ঝিকিমিকির মতো একটি দিন কাটালো বাংলাদেশ। ৪৯ রানে ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশ দিন শেষ করলো ২৫৩ রানে, একই উইকেট নিয়ে। লিটন ও মুশফিকের অবিচ্ছিন্ন ২০৪ রানের ইনিংসটি পাল্টে দেয় গোটা দলের চিত্র। দিনের শুরুটা অস্বস্তির হলেও শেষটা হাসিমাখা। তাইতো ‘বাংলাদেশ-বাংলাদেশ’ সমর্থকদের আনন্দ দ্বিগুণে পরিণত হলো। একটি উদাস বিকেলকে কিভাবে রাঙাতে হয় তা খুব ভালোমতো জানেন লিটন। তাইতো পূর্বের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রানের ফোয়ারাও ছুটতে থাকে। কিন্তু শারীরিক বাঁধায় আটকে যেতে হয় বাববার। আশির ঘরে যেতেই তার হাতে টান পড়ে। ফিজিও বায়েজেদুল ইসলাম এসে ম্যাসাজ করে ব্যথা কমান। কয়েক ওভার পর আবার পিঠে টান পড়ে। আবার মাঠে ঢুকে লিটনকে পিঠে নিয়ে জড়তা ছাড়ান। শেষমেষ কঠিন তপস্যায় মেলে অরাধ্য সেঞ্চুরি। যে সেঞ্চুরির জন্য তার ছয় বছরের অপেক্ষা! মাশরাফি তার প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি দেখেছিলেন ড্রেসিংরুমে বসে। আজ নিশ্চিয়ই টিভির সামনে বসে আনন্দ করেছেন। আর নাজমুল আবেদীন বলে দিলেন, ‘এমন লিটনকেই চায় বাংলাদেশ। দুর্দান্ত এক ইনিংস। অনেক চাপের মধ্যে ছিল। এই ইনিংস নিশ্চয়ই তার ব্যাডপ্যাচ দূর করবে।’ কাক ডাকা সুন্দর সকাল নষ্ট হয় আফ্রিদির ভয়ানক এক বাউন্সারে। যেখানে সাইফ হাসান শিশুতোষ ভুলে ফিরে যান সাজঘরে (১৪) । অবশ্য তার আগে সাদমান ফিরতে পারতেন যদি অতিথিরা ভুল না করতেন। আফ্রিদির করা প্রথম ওভারের পঞ্চম বল সাদমানের ব্যাটের চুমু খেয়ে যায় উইকেটের পেছনে। পাকিস্তানের কোনো সাড়া-শব্দই নেই।
এক ওভার পর হাসান আলীর ভেতরে ঢোকানো বল আঘাত করে সাদমানের প্যাডে। এবারও পাকিস্তানের আবেদন নেই। রিপ্লেতে দেখা যায় বল স্ট্যাম্পের উপরেই ছিল। এলবিডব্লিউর আবেদন করলে আউট হয়ে যেতেন সাদমান। অবশ্য বাঁহাতি ওপেনারকে ফেরাতে বেগ পেতে হয়নি। হাসান আলী ১৪ রানে তাকে ঠিকই এলবিডব্লিউ করেন। তিনে নেমে নাজমুল হোসেন শান্ত আফ্রিদিকে দারুণ এক ফ্লিকে চার মেরে রানের খাতা খুলেন। কিন্তু আগের দুজনের মতো ‘১৪ ঘরের নামতা’ পড়তে পড়তে শান্তও সাজঘরে। ফাহিম আশরাফের অফস্টাম্পের বাইরের বল কাট করতে গিয়ে আলগা শট খেলেন। সাজিদ খান সহজে ক্যাচ নিয়ে শান্তকে প্যাভিলিয়নের পথ দেখান। আগে তার বলেই মুমিনুল হক সাজঘরে। অফস্পিনের স্কিড করা বল ফরোয়ার্ড ডিফেন্স করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন ৬ রান করা মুমিনুল। ৪৯ রানে শেষ স্বাগতিকদের ৪ উইকেট। সাগরিকায় প্রথম দিনে পাকিস্তানের লড়াই ওতোটুকু পর্যন্তই। বাকিটা সময় প্রাপ্তির আনন্দ দোলা দিয়ে গেল। যার পুরোটা কৃতিত্ব মুশফিক ও লিটনের। মুশফিক শুরুতে সময় নিলেও লিটন স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাটিং করেছেন। কভার ড্রাইভ, কাট শটে পেয়েছেন বেশিরভাগ রান। ২২৫ বলে ১১৩ রানের অপরাজিত ইনিংস সাজান ১১ চার ও ১ ছক্কায়। এছাড়া পুল শটে ছিল না জড়তা। আত্মবিশ্বাস নিয়ে শাসন করেছেন গোটা সময়। স্পিনার সাজিদ খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে লং অন দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠান চোখ ধাঁধিয়ে। আর মুশফিক নিজেকে ফিরে পাওয়ার বার্তা দিয়েছেন। ৮২ রানের ইনিংসটি সেঞ্চুরির দাবিদার। লিটন পেরেছেন। মুশফিককে পারতেই হবে। নয়তো রান প্রসবা টেস্টে পিছিয়েই পড়বে বাংলাদেশ।