গুরুদের বিলাসী জীবনই অপরাধী করে তোলে তৃতীয় লিঙ্গের লোকদের

0

রাসেল মাহমুদ॥‘সকালে আমার হাসবেন্ড অফিসে চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পরই বাসার দরজায় কেউ নক করলে গৃহকর্মী গিয়ে দরজা খুলে দেয়। কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ (হিজড়া) আমার বাসায় প্রবেশ করে। আমি বুঝতে পেরেই বাচ্চা আর ফোন নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেই। তারা আমাকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখায় ও হুমকি দেয়। বাসার মধ্যে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে। আমি আমার হাজবেন্ড, থানা ও বাড়িওয়ালার সঙ্গে যোগাযোগ করি। বাড়িওয়ালা এসে দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা কথা বলে এক হাজার টাকা দিয়ে তাদের বিদায় করে। এরই মধ্যে আমার হাজবেন্ড, পুলিশ তারাও আসে।’ ঘটনাটি এভাবেই বলছিলেন রাজধানীর পশ্চিম রামপুরা এলাকার বাসিন্দা সদ্য মা হওয়া সুরুরুম মারফুয়া। শুধু এ এলাকা নয়, রাজধানীসহ সারাদেশে এমন ঘটনা ঘটছে। অনেকে তাদের হাত থেকে বাঁচতে নানা কৌশল নিলেও কেউ কেউ হয়রানির শিকার হন।


জানা যায়, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের হয়রানি থেকে বাঁচতে গত বছর রাজধানীর পল্লবীতে এক বাসিন্দা পুলিশ সদরদপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স উইংয়ে তার বাসস্থানের পার্শ্ববর্তী এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের উৎপাত ও হয়রানির কথা উল্লেখ করে একটি বার্তা পাঠান। বার্তায় তিনি উল্লেখ করেন, তৃতীয় লিঙ্গের কিছু মানুষ নবজাতক শিশু ও ঈদসহ পারিবারিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি ও ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে গিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে দুই থেকে তিন হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। কেউ না দিতে চাইলে বা কারও দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে তার সঙ্গে অত্যন্ত অশোভন আচরণ করেন তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে চাঁদাবাজির অভিযোগে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের সতর্ক করে পুলিশ। অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, যাত্রী, পথচারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, নবজাতক ও শিশুদের জিম্মি করে অভিভাবকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা বাগানো, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদকসহ নানা অপরাধে যুক্ত তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা। এসব ঘটনা কী পরিমাণ ঘটছে তার কোনো সঠিক তথ্য না থাকলেও সম্প্রতি রাজধানীর খিলক্ষেতে তৃতীয় লিঙ্গের সেলিম ওরফে বৃষ্টি (৫০) হত্যা, ২০১৮ সালে মিরপুরে গুরু কোকিলা (৪০) হত্যা, ২০১৬ সালে জামালপুরে হায়দার আলী (৪২) হত্যা, এসব হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে কেউ কেউ চাঁদার টাকার ভাগ না পাওয়ার ক্ষোভে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দেন তারা।
রাজধানীসহ সারাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের রাজত্ব চলে একেকজনের একেক এলাকায়, সেই রাজত্বে অন্যরা হানা দেন না। শিষ্যদের চাঁদা তুলে দিতে হয় গুরুদের। চাঁদা না দিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাদের। ফলে এক্ষেত্রে তৈরি হয় ক্ষোভ। এছাড়া মাঝে মাঝে গুরু-শিষ্যের মধ্যে অর্থের বিরোধও দেখা দেয়। এ বিরোধ দেখা দিলেই ঘটে বিপত্তি। মারামারিসহ তখন হত্যার ঘটনাও ঘটে। এমন বিরোধের জেরে ২০১৮ সালে মিরপুরে তৃতীয় লিঙ্গের গুরু কোকিলা (৪০) হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বিভিন্ন সংস্থা বা তৃতীয় লিঙ্গের সংগঠনগুলোতে এ নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকলেও গত এক দশকে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে দেশজুড়ে। তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের নানা অপরাধের বিষয়ে ‘পদ্মকুড়ি হিজড়া সংঘ’র সহ-সভাপতি মিতু জাগো নিউজকে বলেন, সাধারণত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্যে যেসব তিক্ততা তৈরি হয় সেগুলো মিটে যায়। তারপরও গুরু-শিষ্যের স্বার্থে আঘাত লাগলেই মারামারি ও খুনের ঘটনা ঘটে। একটি পরিবার হয়ে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা থাকে। সেখানে কথা কাটাকাটি হতেই পারে। ছেলের হাতে বাবা-মা খুন হয় এসব ঘটনা আমরা সাধারণ পরিবারেও ঘটতে দেখি। তবুও যেসব অঘটন ঘটে তার থেকে বের হয়ে আসার জন্য বেশি জরুরি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া। কারও ওপর নির্ভরশীলতা কমে এলে নানা ধরনের যে অপরাধের কথা বলা হচ্ছে তা কমে আসবে।
গবেষক, সমাজবিজ্ঞানীসহ অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক, খুন এসব ঘটনা ঘটার পেছনে তাদের প্রতি সমাজের নিগ্রহ দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হতে না পারা, তৃতীয় লিঙ্গের গুরুদের বিলাসী জীবনসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়গুলো জড়িত হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. জিয়া রহমান বলেন, মাল্টি-কালচারালিজমের মূল বিষয়টি হলো সবার অধিকার নিশ্চিত করা। তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানসিক কষ্টটা বেশি। তাদের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব। সমাজের নিগ্রহমূলক দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই মানসিক যন্ত্রণা, হতাশা ও উগ্র-বিচ্যুতিমূলক আচরণগুলো ঘটে। তবে নানা অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে এ অপরাধ বিশ্লেষক বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার পেছনে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ না পাওয়া, অর্থনৈতিক কাজের সুযোগ না থাকা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনীতিক কারণও সম্পৃক্ত। একটি গোষ্ঠী তাদের ব্যবহার করে নানা অপরাধে যুক্ত করছে। এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তৈরি করছে এমন ঘটনাও দেখা গেছে। একটি বিরাট ব্যবসাও রয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের গুরুদের, যার মাধ্যমে তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারে। এই প্রবণতা বাড়ছে বলেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে।
ড. জিয়া রহমান বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অপরাধ কমাতে হলে তাদের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো দরকার। ভালো কাজের স্বীকৃতি বা পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহিত করার পাশাপাশি আইনের মাধ্যমে অস্বাভাবিক কাজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যথায় অপরাধমূলক কাজ অব্যাহত থাকবে। সেই সঙ্গে সহজে এসব কাজ থেকে তাদের বিরত রাখতে হলে গবেষণা ও তথ্য বা ডাটা থাকাও জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের ওপর কাজ করা গবেষক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, অপরাধ শুধু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ করে তা নয়। অন্যরাও করে। তাদের অপরাধটা আমরা বড় করে দেখি। নিচু শ্রেণির বলে আমরা ভাবি, সে কে চাঁদা নেবে, এটা করবে? ড. জোবাইদা বলেন, তাদের কাজ নেই, কোনো কর্মসংস্থানও নেই। তাই চাঁদা তুলছে। যদি কাজ থাকতো তাহলে এ কর্মকাণ্ড অনেকটাই কমে যেতো। আর মারামারি-দ্বন্দ্বের ফলে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধ করলে সেটা রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা তো রয়েছেই।