ট্রাফিক ব্যবস্থারও দ্রুত পরিবর্তন হবে

0

রুদ্র মিজান॥ নতুন আইন। মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ। মামলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবু ফিরেনি শৃঙ্খলা। উল্টো বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। মামলায় অতিষ্ঠ হয়ে নিজের বাইক নিজে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে ঢাকার সড়কে। কোথাও ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে ছুটে যাচ্ছে যানবাহন। একই সড়কে এলোমেলোভাবে চলছে রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, বাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, ভ্যান, পণ্যবাহী গাড়ি। কোথাও কোথাও উল্টোপথে চলছে রিকশা। এমনকি সিএনজি অটোরিকশা ও প্রাইভেট গাড়িও উল্টো চলতে দেখা যায়। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হিমশিম খাচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। তারা জানিয়েছেন, শৃঙ্খলা ফেরাতে চালক থেকে শুরু করে পথচারীদেরও সচেতন হতে হবে। সচেতনতা ছাড়া সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্ট মাসে সারা দেশে মোট ৮০ হাজার ১৩৭টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। জরিমানা করা হয় হয়েছে ২৫ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার ৭৪৫ টাকা। ট্রাফিক পুলিশ সূত্র জানায়, গড়ে প্রতিদিন আড়াই হাজার মামলা হচ্ছে। জরিমানা হচ্ছে প্রায় কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি মামলা হচ্ছে মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টরা জানান, সাধারণত মোটরসাইকেল চালকরা আইন মানেন কম। সুযোগ পেলেই সিগন্যাল অমান্য করে চলে যান। তাছাড়া মোটরসাইকেল, গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা চালকরা জেব্রা ক্রসিং মানতে চান না। একইভাবে জেব্রা ক্রসিং ছাড়াও যততত্র রাস্তা পার হন পথচারীরা। তেজগাঁও এলাকায় কথা হয় সার্জেন্ট দুর্জয়ের সঙ্গে। তিনি জানান, রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশা চালকরা আইন বোঝেন কম। মানেন কম। আবার বাইক চালকরা জেনে-বুঝে আইন অমান্য করেন। মামলা দিয়েও শৃঙ্খলা পুরোপুরি না ফিরলেও দিন দিন উন্নতি হচ্ছে বলে মনে করেন মাঠ পর্যায়ের এই ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা। একই কথা বলেন সার্জেন্ট সমরেশ। তিনি বলেন, রাতের বেলা কাভার্ডভ্যান, প্রাইভেট গাড়ি, পণ্যবাহী গাড়িগুলো দ্রুতগতিতে বেপরোয়াভাবে চলে। এসব অনেক গাড়ির সঠিক কাগজ থাকে না। আমরা প্রায়ই আটক করে মামলা দিচ্ছি। মগবাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে গতকাল রাত ১০টার দিকে দেখা গেছে, ৪ রাস্তার এই মিলনকেন্দ্র সামলাতে বেশ বেগ পাচ্ছিলেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। একটু ফাঁকা পেয়ে কয়েক রিকশা সিগন্যাল অমান্য করেই ছুটে যাচ্ছিল মালিবাগের দিকে। এর মধ্যে একটি বাইক ছুটে যায় কাকরাইলের দিকে। তখন সিগন্যাল ওপেন হওয়ায় বাংলামোটর হয়ে মগবাজারের দিকে গাড়িগুলো যেতে শুরু করেছে মাত্র। এর মধ্যেই একটি বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায়। তবে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে ফাঁকা রাস্তায় বড় ধরনের ও পরিসংখ্যানে সব চেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটায় যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যানবাহন।
সূত্রমতে, ২০২০ সালে ৪০৯২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৯৬৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৫ জন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ট্রাফিক) অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণ রয়েছে। দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী গাড়ির চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা, ওভারটেকিং, বিরতি ছাড়াই র্দীঘসময় ধরে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো, মহাসড়ক নির্মাণে ত্রুটি, একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহন চলাচল এবং রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাটের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময় পথচারীদের সচেতনতার অভাবেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। দুর্ঘটনার নেপথ্যে একেক স্থানের ক্ষেত্রে একেক কারণ। দুর্ঘটনা এড়াতে, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে আইন প্রয়োগ করা হয়। তারপরও সড়কে শৃঙ্খলা না ফেরার কারণ হিসেবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা বলেন, চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে ‘সড়ক পরিবহন আইন’ করা হয়েছে। আইন ভঙ্গ করলে মামলা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু শুধু আইন করে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন। শৃঙ্খলার জন্য প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। মাইন্ডসেট। আইন আরোপ করা হয় ইচ্ছের বিরুদ্ধে। সাময়িক শাস্তির জন্য। নিয়ম মানতে অভ্যস্ত করার একটি প্রক্রিয়া। যখন মানসিকতার পরিবর্তন হবে। মানুষ নিয়ম ভঙ্গ করবে না তখন আইন প্রয়োগের প্রয়োজন হবে না। এক্ষেত্রে শিক্ষা, পারিপার্শ্বিকতা গুরুত্বপূর্ণ। ডিএমপি’র (ট্রাফিক) অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, আইন ভঙ্গ করলে ট্রাফিক পুলিশ ভূমিকা রাখে। এটা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব। তবে সবাই আইন সম্পর্কে জানে না। একজন গৃহবধূ বা কিশোর হয়তো আইন সম্পর্কে জানে না। তাদেরকে অবগত করতে, সচেতন করতে নানা ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করে ট্রাফিক পুলিশ। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারসহ আইন মানতে উদ্বুদ্ধ করা হয় এসব কর্মসূচির মাধ্যমে। ২৭শে সেপ্টেম্বর ট্রাফিক পুলিশের মামলায় অতিষ্ঠ হয়ে বাড্ডা লিঙ্ক রোডে নিজের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেন শওকত আলী নামে একজন বাইকার। তিনি অ্যাপসের মাধ্যমে রাইড শেয়ার করতেন। এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি এজন্য ব্যথিত। জরিমানা করার আগে তিনি নিজেই নিজের বাইক পুড়িয়েছেন। খবর পেয়ে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখেছি। সার্জেন্টের পেশাদারিত্ব বজায় ছিল কি-না, তা দেখেছি। পর্যালোচনা করেছি। কিন্তু সার্জেন্টের কোনো অপেশাদারিত্ব পাইনি। জানতে পেরেছি, এর আগে ৯ই সেপ্টেম্বর রমনা এলাকায় একটা মামলা দেয়া হয় ওই বাইকারকে। তাছাড়া তিনি আর্থিক টানাপড়েনে ছিলেন। ঋণগ্রস্ত ছিলেন। মানসিকভাবে স্থিতিশীল ছিলেন না। যে কারণে আরেকটি মামলা হবে, এটি তিনি মেনে নিতে না পেরে বাইক পুড়িয়েছেন। নানা সমস্যা, সংকটের মধ্যেও ট্রাফিক পুলিশ চেষ্টা করছে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এমনটি দাবি করে ডিএমপি’র (ট্রাফিক) অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, দেশ উন্নত হচ্ছে। দেশের প্রতিটি প্যারামিটারও এগিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। ট্রাফিক ব্যবস্থারও দ্রুত পরিবর্তন হবে। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সিস্টেম সক্রিয় করতে আমরা চেষ্টা করছি।