অ্যাপসের কমিশন নিয়ে ক্ষোভ

0

মরিয়ম চম্পা॥ শাহবাগ মোড়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন পাঠাও চালক সাব্বির হোসেন। পাশে থাকা বিআরটিসি ডাবলডেকার বাসের হেলপারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীকে ডাকছেন। বলছেন, ভাই যাবেন? অন্যদের চেয়ে ভাড়া কিছুটা কম নিবো। সারা দিনে খুব বেশি খ্যাপ হয়নি। সাব্বিরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। দীর্ঘদিন সরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য চেষ্টা করেও ফল হয়নি। পরে অ্যাপভিত্তিক পাঠাও রাইড শেয়ারের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি বলেন, শুরুর দিকে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিকে শতকরা ১৫ ভাগ কমিশন দিলেও এখন সেটা বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে।
এদিকে রাস্তায় বের হলেই আতঙ্কে থাকি এই বুঝি ট্রাফিক পুলিশ মামলা দেয়। তার ওপর কোম্পানির টাকার বোঝাতো মাথায় আছেই। সারাদিন কষ্ট করে ৫ থেকে ৭শ’ টাকা আয় করলে তার মধ্যে থেকে শতকরা ২০ টাকা কোম্পানিকে দিলে অবশিষ্ট আর কি থাকে? তিনি বলেন, যত দিন যাচ্ছে রাইড শেয়ারিং পেশাটা খুব জটিল হয়ে যাচ্ছে। রাজধানীতে যদি মেট্রোরেল চালু হয় সে ক্ষেত্রে রাইড শেয়ারিং পেশাটা আরও সংকুচিত হয়ে যাবে। বর্তমানে অ্যাপভিত্তিক রাইডের প্রতি অনেকেরই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সিএনজি ও রিকশাচালক। তারাতো আমাদের দেখতেই পারে না। রংপুরে মোবাইল ফোন সারাইয়ের কাজ করতো শিক্ষার্থী স্বপন। পাশাপাশি পড়ালেখা করতো। করোনার কারণে মোবাইল ফোন সারাইয়ের দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়। কলেজ বন্ধ থাকায় বন্ধুর পরামর্শে নারায়ণগঞ্জে ফুপুর বাসায় থেকে পাঠাওয়ের মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। স্বপন জানায়, গত তিন মাস ধরে পাঠাও রাইডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। চরম শিক্ষা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই শিক্ষার্থী। জানায়, সারা দিনে ৫শ’ টাকা আয় করলে তার মধ্যে থেকে ১০০ টাকাই যদি কোম্পানিকে দিতে হয় তাহলে নিজে চলবো কীভাবে? আর পরিবারকেই বা কি দেবো। ট্রাফিক পুলিশের তো কথাই নেই। কোনো কথা না শুনেই তারা মামলা দিতে পারলে বাঁচে। আমাদের বিষয়টি কেউ ভেবে দেখে না। স্বপন জানায়, কুরিয়ার সার্ভিসের পার্সেল বিভাগে কাজ পেতে চেষ্টা করছে। পার্সেল ডেলিভারির কাজ পেলে এ পেশায় আর থাকতে চায় না স্বপন। আরেক রাইডার সোহেল বলেন, রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ার সময় রাইডারের সংখ্যা কম ছিল। পার্সেন্টেজও কম ছিল। অল্প ভাড়া হলেও বেশি রাইড দেয়া যেত। দিন শেষে ভালো টাকা আয় হতো। এখন রাজধানীতে এতো রাইডার, বলার অপেক্ষা রাখে না। গ্রাম থেকে অনেকেই একটি মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকায় এসে রাইডার হয়ে যায়। ফলে একটা অ্যাপের কলের জন্য ২৫ থেকে ৩০ জন অপেক্ষা করে থাকে। তাই বাধ্য হয়ে চুক্তিতে যাই। না হলে সারা দিনে যা আয় হবে, তা দিয়ে পরিবার নিয়ে ঢাকা শহরে চলতে পারবো না। রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর নির্ধারিত টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতার জন্য রাজধানীতে অনেকেই যাত্রীদের সঙ্গে চুক্তি করে রাইড শেয়ার করেন। তাদেরই একজন সাদেকুর। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে ড্রাইভিংয়ের কাজ করতেন সাদেকুর রহমান। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও করোনার কারণে কাজ হারিয়ে এখন অ্যাপভিত্তিক রাইডার উবার চালায়। সাদেকুর জানায়, অ্যাপ থাকলেও খ্যাপ নেই। অ্যাপের পার্সেন্টেজের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এখন প্রায় সময় অ্যাপ ডিএকটিভ করে অ্যাপের বাইরে যাত্রী নিয়ে থাকি। ছেলের স্কুলের খরচ, বয়স্ক বাবা-মা, বাসা ভাড়াসহ মাসে খরচ প্রায় ২০ হাজার টাকা। অথচ অ্যাপে রাইড শেয়ার করলে সেখানে মাসে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। সাদেকুরের মতো এখন অনেকেই রাজধানীতে অ্যাপভিত্তিক রাইডের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও দিনের বেশিরভাগ রাইড তারা অ্যাপের বাইরে করে থাকেন।
একটি ফেসবুক গ্রুপ মর্ডারেটর নবাব হাসান খান বলেন, আমরা যখন প্রথম রাইড শেয়ার শুরু করি তখন বাইকের ক্ষেত্রে উবার তো সম্পূর্ণ ফ্রি ছিল। কোনো কমিশন ছিল না। এখন কিন্তু উবার ২৫ শতাংশ কমিশন নিচ্ছে। এবং পাঠাও নিচ্ছে ২০ শতাংশ। এছাড়া পাঠাও মাত্র ১০ শতাংশ কমিশন দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে এটা বেড়ে ১৫ এবং সর্বশেষ ২০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। আগে রাস্তার পরিবেশ পরিস্থিতি যেমন ছিল এবং যেমন রাইড হতো এখন কিন্তু তেমনটি নেই। আগে যদি ১০টি রাইড দেয়া যেত। এখন সেখানে ৫টি রাইড দিতে কষ্ট হয়ে যায়। রাস্তার যানজট, ট্রাফিকদের হয়রানি তো রয়েছেই। তিনি বলেন, করোনাকালীন আমরা সম্পূর্ণ বেকার জীবনযাপন করেছি। পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন গেছে। তখন কিন্তু কোম্পানি থেকে আমাদের কোনো প্রকার আর্থিক সহযোগিতা করা হয়নি। এখন আমাদের একটাই দাবি কমিশন কমিয়ে ১০ শতাংশে আনা হোক। রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও-এর মার্কেটিং ডিরেক্টর এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দা নাবিলা মাহবুব বলেন, পাঠাও রাইড শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা চালকদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ কমিশন নিয়ে থাকি। এছাড়া বিভিন্ন অফারের আওতায় কখনো কখনো এই কমিশন ফি ১০ শতাংশে নেমে আসে। অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল পরিবহন সেবায় চালক ও যাত্রীদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিতে পাঠাও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ বিষয়ে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, চালকদের যেকোনো দাবি-দাওয়া আমরা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকি। করোনাভাইরাস ও লকডাউনের কারণে আমাদের সেবাদাতা রাইডাররা দীর্ঘদিন যাত্রীসেবা থেকে বিরত থেকেছেন। তবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর রাইড শেয়ারিংয়ের চাহিদা ও চালকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বাড়ছে বলে জানান তিনি।