২৮১ কোটি টাকার বিদেশি ঋণ নিয়ে প্রশ্ন

0

কাজী সোহাগ॥ ৩৫১ কোটি টাকার প্রজেক্ট। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ ২৮১ কোটি টাকা। বাকি ৭০ কোটি টাকার জোগাড় হবে নিজস্ব অর্থায়নে। বিদেশি ওই ঋণ নেয়া হচ্ছে এক্সিম ব্যাংক কোরিয়া নামক কমার্শিয়াল উইন্ডো থেকে। এত কম টাকার একটি প্রজেক্টে বিদেশি ঋণ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। শুধু প্রযুক্তি সহায়তা নিতেই কোরিয়া থেকে এ ঋণ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়ের এ যুক্তিতে সন্তুষ্ট নয় সংসদীয় কমিটি। ঘটনাটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের।
প্রকল্পের নাম-ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপের মাধ্যমে ৩টি সিটি করপোরেশন, ১টি পৌরসভা এবং ২টি গ্রামীণ উপজেলার ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি স্থাপন প্রকল্প। প্রকল্পের সময় শুরু ২০১৮ সাল থেকে। শেষ করার কথা চলতি বছরের ডিসেম্বরে। কিন্তু ওই প্রকল্পের কাজ এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। তাই কবে শেষ হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। অল্প টাকার ঋণ হলেও তা ছাড় দিতে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানটি নানা ধরনের শর্ত জুড়ে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি ঘিরে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১০ম বৈঠকের (মার্চে অনুষ্ঠিত) কার্যবিবরণীতে এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রী, সচিব ও সংসদীয় কমিটির সদস্যরা আলোচনা করেন। কমিটির সভাপতি পাবনা-৩ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি মকবুল হোসেন বৈঠকে প্রকল্পটি নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, সরকারের এখন টাকার অভাব নেই। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মাত্র ২৮১ কোটি টাকা কেন এক্সিম ব্যাংক কোরিয়া নামক কমার্শিয়াল উইন্ডো থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে? প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাল জুলাই ২০১৮ থেকে ডিসেম্বর ২০২১। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুই হয়নি। যেহেতু প্রকল্পটি নতুন এখানে বাস্তবায়ন নিয়ে কিছু বলার নেই। তবে, তিনি দয়া করে কমিটিকে জানাতে অনুরোধ করেন যে, অর্থ ছাড় হতে বিলম্বের কারণ আমরা না কোরিয়ান কর্তৃপক্ষ? কমিটির সভাপতি বলেন, কমার্শিয়াল উইন্ডো থেকে লোন গ্রহণ করলে সাধারণত গ্রেস পিরিয়ড থাকে না এবং নন কনসেশনাল হয়। রিপেমেন্ট বা সুদের হার বেশি হয়। আবার প্রসেসিং ফিও গ্রহণ করে থাকে। এই প্রকল্প সাহায্য এক্সিম ব্যাংক, কোরিয়া থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এই ফাইন্যান্সিং সোর্সটি কমার্শিয়াল লোন প্রদান করে। অর্থাৎ লোনের খরচ বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। পরামর্শকের জনমাস ৩৮ এর পরিবর্তে ১৩০ জনমাস কেন করা হলো? আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগের আরএফপি কি ওপেন না শুধুমাত্র কোরিয়ান পরামর্শক অংশগ্রহণ করতে পারবে? পরামর্শক নিয়োগ কোয়ালিটি অ্যান্ড কষ্ট বেইজড সিলেকশন-এর পরিবর্তে কোয়ালিটি বেইজড সিলেকশন কেন করা হচ্ছে? অর্থাৎ এক্ষেত্রে খরচ বাড়বে আবার কোয়ালিটি কতোটুকু নিশ্চিত হবে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। এটা স্বচ্ছতার সঙ্গে হওয়া প্রয়োজন। প্রকল্প শেষ হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পরামর্শক ও স্থানীয় পরামর্শক বাবদ কতো ব্যয় ধরা হয়েছে। আবার গাড়ি ক্রয় করা হয়েছে, জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। এগুলোর জন্য খরচ হচ্ছে। ওভারহেড কস্ট বেড়ে যাবে। ডিপিপি অনুযায়ী খরচ মেলানো যাবে না। সুতরাং সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। এসব প্রশ্নের জবাবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তাফিজুর রহমান সংসদীয় কমিটিকে বলেন, প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ০.৫৩ ভাগ এবং ভৌত অগ্রগতি ০.০৭ ভাগ। বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতির জরিপে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর লেগে যায়। কোরিয়ান এই প্রযুক্তিতে ড্রোন দিয়ে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে ডিজিটাল জরিপ করা হয়, যা বিশ্বের দ্বিতীয় কোনো স্থানে হয় নাই। বাংলাদেশ এই প্রযুক্তিতে আগ্রহ দেখালে তারা কিছু শর্ত জুড়ে দেয়। যার মধ্যে একটি হলো তাদের পরামর্শক নিয়োগ করা। পরামর্শক নিয়োগ-বিষয়ক জটিলতার কারণে কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে। তবে ইতিমধ্যে পরামর্শক নিয়োগের ইভাল্যুয়েশন শেষ হয়েছে, যা এক্সিম ব্যাংকের ক্লিয়ারেন্সের জন্য পাঠানো হবে। ক্লিয়ারেন্স পেলে মন্ত্রীর অনুমতিক্রমে আন্তর্জাতিক পরামর্শকের সঙ্গে লোকাল কিছু পরামর্শক ও স্থানীয় কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে অল্পদিনের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। উল্লেখ্য, প্রকল্পের ঋণের সুদ হার ০.০১ ভাগ যা নামমাত্র। বিষয়টি নিয়ে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, কোরিয়ান প্রযুক্তিটি নিয়ে আসাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তবে বিলম্ব হওয়ার জন্য আমাদের সমস্যার চেয়ে তাদের সমস্যা বেশি ছিল। কোভিডজনিত কারণে এবং এক্সিম ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজে বিলম্ব হচ্ছে। দেশে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল জরিপ ও দেশের কর্মীদের দক্ষ করার ইচ্ছা থেকেই প্রকল্পটি বাতিল করা থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। মন্ত্রীর এ বক্তব্যে উষ্মা প্রকাশ করেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি। তিনি বলেন, সরকারের বর্তমানে টাকার অভাব নেই। কিছুদিন আগে ভূমি মন্ত্রণালয়কে প্রায় হাজার তিনশত কোটি টাকার দুইটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সে কারণে তিনশ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঋণ নিয়ে করার প্রয়োজন ছিল না। ঋণের সঙ্গে আবার কিছু শর্ত বেঁধে দেয়া হয়েছে। বিদেশি পরামর্শক না নিয়ে, দেশের কর্মীদের প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন। বৈঠকে মৌলভীবাজার-৩ আসনের এমপি নেছার আহমদ বলেন, বিদেশি টেকনোলজি আনার ক্ষেত্রে, যাতে ব্যয় কম আর কাজ বেশি হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এটি জননেত্রী শেখ হাসিনার মূল বক্তব্য। এটি হলেই দেশের অগ্রগতি হবে এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাজ সহজ করার জন্য ডিজিটাল জরিপ করার মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে পারা যাবে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংসদীয় কমিটি জানিয়েছে, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করে মৌজা ম্যাপ ও খতিয়ান প্রস্তুত করা। জনগণের ভূ-সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান, ভূমি বিবাদ হ্রাস, ভূমি রাজস্ব বর্ধিতকরণ এবং সরকারি ভূমি ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা অর্জনসহ একটি দক্ষ ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। পাশাপাশি সর্বশেষ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, দ্রুত ও উন্নত ভূমি তথ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভূমি মালিকগণকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ২০১৬ সালের ২২শে জুন একটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের পর ২০১৮ সালের ২১শে জুন অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়।