আট অস্ত্রসহ আকুলকে আটকের পর বেরিয়ে আসছে অজানা সব তথ্য

0

সুন্দর সাহা॥ সীমান্ত শহর বেনাপোলের ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসীর নাম আকুল হুসাইন। আকুল সীমান্ত এলাকাজুড়ে গড়ে তোলে দুর্ধর্ষ এক অপরাধীচক্র। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠণের শীর্ষ নেতা তার সাথে রয়েছে নিকট আত্মীয় এক পুলিশ কর্মকর্তার আশির্বাদ। যে কিনা আকুলকে “বিশেষ ব্যবস্থায়” সব অপকর্ম থেকে রক্ষা করে এসেছেন। এমন কি এর আগে বিপুল অস্ত্র-বোমাসহ আটক হলেও আকুলকে আটকে রাখা যায়নি। বেনাপোল থানায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হলেও আলোচিত সেই পুলিশ কর্মকর্তার বদান্যতায় রক্ষা পায় সীমান্তের এই শীর্ষ সন্ত্রসী। এমনকি বিপুল অর্থের হাত বদলে মামলার অভিযোগপত্র থেকে আকুলের নামটাও বাদ দেয় পুলিশ।


সম্প্রতি অস্ত্রের চালান পৌঁছে দিতে ঢাকায় আসার পথে আকুলসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে বেরসিক ডিবি পুলিশ। l দুর্ধর্ষ বাহিনী প্রধান আকুল হোসাইন শার্শা থানা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পদক ও জেলা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি। তার পিতার নাম নজরুল ইসলাম। আর আকুলের সাথে অস্ত্রসহ যে চার সহযোগী আটক হয়েছেন তারা হলেন, বেনাপোল পোর্ট থানার দূর্গাপুর গ্রামের মৃত ইহান আলীর ছেলে সাপের বিষ সিন্ডিকেটের হোতা অস্ত্রবাজ আব্দুল আজিম ওরফে আজিম উদ্দীন(২৮), বড় আঁচড়া গ্রামের আমির আলীর ছেলে অস্ত্র ‌ব্যবসায়ী ইলিয়াছ হোসেন (৩১), আরেক অস্ত্র কারবারী হচ্ছে বেনাপোলের বোয়ালিয়া গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে ফারুক হোসেন মিলন (২৮) ও এই চক্রের আরেক দোষর ভবেরবেড় গ্রামের আজিবর রহমানের ছেলে ড্রাইভার ফজলুর রহমান (৩৫)। এদিকে আকুল ও তাঁর সহযোগীদের গ্রেপ্তারের পর নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনি কাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছেন, সীমান্তের দুই পাশে কঠোর পাহারা থাকার পরও কিভাবে এসব অস্ত্র দেশে এনেছিলেন, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে।


পুলিশ-সাংবাদিক এবং বেনাপোল সীমান্তের সূত্রগুলো বলছে, একাধিক সন্ত্রাসী, চোরাচালানি, ছিনতাইকারী, মাদক কারবারি, টেন্ডারবাজ, অস্ত্রবাজ, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজী, অপহরণকারীসহ বিভিন্ন কুচক্রী চক্রের সঙ্গে সখ্য রেখে দীর্ঘদিন অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য কেনাবেচা করছেন আকুল ও তাঁর সহযোগীরা। স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডি পাচার, ইয়াবা, আইস, ফেনসিডিল কেনাবেচা ও ছিনতাইয়ের সঙ্গেও তাঁদের যোগসূত্র রয়েছে। এবিষয়ে জানতে চাইলে গোয়েন্দা বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, “আকুলসহ আরো যারা অস্ত্র কারবারে জড়িত, তাদের ধরার চেষ্টা চলছে। অস্ত্রের ক্রেতাদের একটি তালিকা আমরা পেয়েছি। তালিকা যাচাই-বাছাইসহ অস্ত্রগুলোর সন্ধান করা হচ্ছে।”


গোয়েন্দাদের ভাষ্য, আকুল মূলত তিন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করতেন। এগুলো হচ্ছে- ৯ এমএম, ৫ ইঞ্চি ব্যারেলের ৭ পয়েন্ট ৬৫ এমএম ও ৩ ইঞ্চি ব্যারেলের ৭ পয়েন্ট ৬৫ এমএম পিস্তল। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, “ভারতের চোরাকারবারিরা একটি ৯ এমএম পিস্তলের জন্য ৬১ হাজার রুপি, ৫ ইঞ্চি ব্যারেলের ৭ পয়েন্ট ৬৫ এমএম পিস্তলের জন্য ৫১ হাজার রুপি ও ৩ ইঞ্চি ব্যারেলের ৭ পয়েন্ট ৬৫ এমএম পিস্তলের জন্য ৪১ হাজার রুপি রাখে। আকুল এগুলো বাংলাদেশে যথাক্রমে এক লাখ ২০ হাজার, ৯০ হাজার ও ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন।” জিজ্ঞাসাবাদে আকুল স্বীকার করেছে, ভারতের চোরাচালানকারীরা এই অস্ত্র ও গুলি সেখানকার কারখানায় তৈরি করে।

পরে এগুলো কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এদিকে, ভারতের একজন অস্ত্র চোরাচালানকারী ও আকুলের মধ্যকার কথোপকথনের একটা ভিডিও ক্লিপ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ভিডিও ক্লিপে আকুলকে ভারতীয় চোরাচালানকারীর কাছে ২০ পিস ৭ পয়েন্ট ৬৫ এমএম পিস্তল চাইতে শোনা যায়। তখন ভারতীয় চোরাচালানকারী জানান, তার কাছে মাত্র ৩ পিস আছে। তবে সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে তিনি পুরো চালানটা দিতে পারবেন। আকুল দাম জানতে চাইলে ভারতের ওই চোরাকারবারি প্রতিটি আগ্নেয়াস্ত্রের দাম চান ৪১ হাজার রুপি। কথোপকথনের সময় আকুল ও ভারতীয় চোরাকারবারিকে কিছু সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করতেও শোনা যায়। যেমন- বুলেটের বদলে খাবার। ৪০০ থেকে ৫০০ বুলেটের একটি চালানের জন্য ভারতীয় চোরাচালানকারী প্রতিটি বুলেটের জন্য ৮০০ রুপি দাবি করেন।


এদিকে আকুল গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছে যে, ভারতের তিনজন ডিলারের কাছ থেকে তিনি অস্ত্র আনতেন। এক্ষেত্রে অস্ত্র ও গুলি প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়িয়ে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে রাখতেন তারা। সীমান্তে সতর্কতা কিছুটা শিথিল হলে ভারতের চোরাকারবারিরা বাংলাদেশিদের কাছে চালান পাঠায়। এই কাজে অপরাধীরা স্থানীয় দিনমজুরদের কাজে লাগায়। যারা অর্থের একটি অংশ পায়। ডিবি সূত্র জানায়,’আগে ভারতে প্রতিটি আগ্নেয়াস্ত্রের মূল্য ছিল ২৮ থেকে ৩০ হাজার রুপির মধ্যে। যেটা তারা বাংলাদেশে ৪৫ থেকে ৫০ হাজারে বিক্রি করত। কিন্তু এখন এই দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই আগ্নেয়াস্ত্র গুলো স্বয়ংক্রিয়। এবং এগুলোর ওপর “মেড ইন ইউএসএ” লেখা আছে,’ সূত্রটি নিশ্চিক করেছে। আকুলের সাথে আটক চোরাচালান চক্রের বাংলাদেশি অন্য সদস্যরা বলেন, তারা মূল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কোনো অংশ অরক্ষিত পেলেই অস্ত্রের চালান নিয়ে আসেন।


গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, এই চক্রটির প্রধান আকুল হোসেন ২০১৪ সাল থেকে দুই শতাধিক অবৈধ অস্ত্র নিজে বিক্রি করেছে। অস্ত্র চোরাচালানসহ চক্রের সদস্যরা প্রতারণা, সীমান্ত পিলার, সাপের বিষ, গোল্ড স্মাগলিং, প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তি, ইয়াবা, আইস মাদক চোরাচালানে জড়িত। সীমান্তের সূত্রগুলো আরও জানায়, আকুল এবং তার বাহিনীর সদস্যরা স্বর্ণ ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সোনা, ডলার ও টাকা কেড়ে নেয়ার জন্য গড়ে তোলে বিশাল এক নেটওয়ার্ক। সূত্র আরও বলছে, ২০১৯ সালের ১৪ জুন আকুল হোসেনের বাড়ি থেকে পুলিশ তিনটি গুলি, ১২টি ম্যাগাজিন, একটি বোমা, ছয়টি হাঁসুয়া, একটি চাপাতিসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করে। এ ঘটনায় বেনাপোল থানায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হলেও অজ্ঞাত কারণে মামলার অভিযোগপত্র থেকে আকুলের নাম বাদ দেয় পুলিশ। আকুলের সেই নিকট আত্মীয় পুলিশ কর্মকর্তা বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে চার্জশীট থেকে আকুলের নাম বিশেষ ব্যবস্থায় বাদ দেয়ার ব্যবস্থা করেন।


এদিকে আন্তঃদেশীয় অস্ত্র পাচার সিন্ডিকেটের হোতা বাহিনী প্রধান আকুল ও তার সহযোগীদের গ্রেফতারের পর নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ২০১৯ সালে ধরা পড়ার পরও তিনি কীভাবে জামিনে বেরিয়ে এলেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, সোনা ছিনতাই, মারামারিসহ কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর হামলাসংক্রান্ত আটটি মামলা রয়েছে। তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক কারা, এখন পর্যন্ত তিনি কাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছেন, সীমান্তের দুই পাশে কঠোর পাহারা থাকার পরও কীভাবে এসব অস্ত্র দেশে এনেছিলেন, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে। এ বিষয়ে বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন খান বলেন, ‘আকুলের বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গুলি ও মাদক উদ্ধারের ঘটনায় দুটি মামলা হয়। তবে মামলার অভিযোগপত্রে আকুলের নাম আসেনি। আমি এই থানায় আসার আগের ঘটনা এটি।’ তিনি বলেন, আকুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র, চাঁদাবাজি, সোনা ছিনতাই, মারামারি, কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর হামলাসহ আটটি মামলা রয়েছে।