চিংড়ি রফতানিতে বিপর্যয় মোকাবেলায় ভেনামিতে ভরসা

0

এহতেশামুল হক শাওন, খুলনা॥ উপকূলীয় অঞ্চলে রফতানিমুখি বাগদা-গলদা চিংড়ির উৎপাদন প্রতি বছর কমছে। শুধুমাত্র কাঁচামালের অভাবে একবারেই বন্ধ হয়ে গেছে ৭৭টি মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। আন্তর্জাতিক বাজারে হিমায়িত চিংড়ির প্রায় ৮০ ভাগ ভেনামি (একটি বিদেশি প্রজাতির চিংড়ি মাছ) চিংড়ির দখলে। বিশ্বের ৬৫ থেকে ৭০টি দেশে এবং এশিয়ার ১৪টি দেশে ভেনামি চিংড়ির চাষ হয়। শুধুমাত্র বিদেশি প্রজাতির দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে এ মাছের বাণিজ্যিক চাষ বন্ধ রাখা হয়েছে। চিংড়ি সেক্টর সংশ্লিষ্টদের দুই দশকের প্রচেষ্টার পর সরকার পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি চাষের অনুমতি দিলে আশাতীত সাফল্য আসে। প্রচলিত পদ্ধতির চিংড়ি চাষে উৎপাদনের বিপরীতে ভেনামি চাষে ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরে সাড়ে ছয় হাজার কেজি বেশি। ফলে আশার আলো দেখছেন চিংড়ি চাষি ও রফতানিকারকরা। খুব দ্রুত নীতিমালা তৈরি করে ভেনামি চাষ উন্মুক্ত করে দিলে হিমায়িত চিংড়ি রফতানিতে বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের পরিসংখ্যান ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশে বাগদা ও গলদা চিংড়ির উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, মাত্রাতিরিক্ত তাপপ্রবাহ, পানির লবনাক্ততা বৃদ্ধি, বারবার সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত, সর্বপরি ভাইরাসের আক্রমণে চিংড়ি চাষে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রয়োজনীয় উৎপাদন না হওয়ায় এবং উৎপাদনে অতিরিক্ত ব্যয় হওয়ায় হিমায়িত কারখানাগুলো ভুগছে কাঁচামাল সংকটে। বাজার সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় ও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে হিমায়িত চিংড়ি রফতানির প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশের ব্লাক টাইগার খ্যাত বাগদা চিংড়ি যেখানে হেক্টর প্রতি মাত্র ৩১৪ কেজি উৎপাদন হয়, সেখানে ভেনামি চিংড়ি হয় প্রায় ১০ মে. টন। বাগদা চাষ করে বিক্রি উপযোগী করতে পাঁচ মাস সময় লাগে, সেখানে ভেনামি চিংড়ি চাষে লাগে সর্বোচ্চ তিন মাস। এছাড়া বাগদা চিংড়ি বছরে মাত্র একবার চাষ করা গেলেও ভেনামি চাষের সুযোগ রয়েছে বছরে তিনবার। ভেনামি চিংড়ি তাপ সহনশীল, লবনাক্ততা সহনশীল। রোগ বালাইয়ের আক্রমণ কম। মর্টালিটি রেট বা পোনা মৃত্যুর হার বাগদা গলদার চেয়ে অনেক কম। এজন্য ভেনামি চিংড়ি চাষের ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি চাষ সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিতে আনা হয় মূলত ২০০৫ সালে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত শুধু চলছে গবেষণা। তিন বছর আগে সরকার দেশের দুটি জায়গায় পরীক্ষামূলক ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের অনুমতি দেয়। একটি কক্সবাজার, অপরটি খুলনায়। খুলনার পাইকগাছা লোনাপানি কেন্দ্রের ছয়টি পুকুর ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে এ সংক্রান্ত সরকারের সাথে একটি চুক্তি হয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের। স্থানীয় উদ্যোক্তা হিসেবে সুশীলন যশোরের এম ইউ সী ফুড নামের একটি রফতানিকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেয়। চলতি বছরের ৩১ মার্চ থাইল্যান্ড থেকে ১০ লাখ ভেনামির পোনা এনে লোনাপানি কেন্দ্রের চারটি পুকুরে ছাড়া হয়। পর্যায়ক্রমে চারটি পুকুর থেকেই মাছ সংগ্রহ করে সর্বশেষ ফলাফলে দেখা যায় হেক্টর প্রতি প্রায় ১০ মে. টন বা ১০ হাজার কেজি উৎপাদন সম্ভব। কেজি প্রতি ৩১০ থেকে ৩২০ টাকা খরচ পড়লেও এর বিক্রয়মূল্য পাঁচশ’ টাকার উপরে।
এম ইউ সী ফুডস লি: এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস জানান, অনুমতি হয় ২০১৯ এর শেষের দিকে। ২০২০ এ থাইল্যান্ড থেকে পোনা এনে অবমুক্ত করার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু কোভিডের উদ্ভুত পরিস্থিতে সেটি আনা সম্ভব হয়নি। এ বছর ৩১ মার্চ ১০ লাখ পোনা সিপি থাইল্যান্ড থেকে আনা হয় এবং সেদিনই পাইকগাছার লোনা পানি কেন্দ্রে অবমুক্ত করা হয়। তবে পোনা আনতে গিয়ে দুই লাখের কিছু বেশি মৃত্যু হয়। লোনা পানি কেন্দ্রের ৬টি পুকুর তাদেরকে দেয়া হলেও তার মধ্যে চারটিতে পোনা ছাড়েন। ৯০ দিন থেকে শুরু করে ১০৭ দিনের মধ্যে সর্বশেষ পুকুর থেকে মাছ সংগ্রহ করা হয়। চারটি পুকুরে প্রায় ১৩ হাজার কেজি মাছ উৎপাদন হয়। যার জমির পরিমাণ ছিল আড়াই হেক্টর। তিনি নিজেও একটি রফতানি কারখানার এমডি হিসেবে দীর্ঘদিন থেকে কাঁচামালের অভাব অনুভব করছিলেন। কিন্তু ভেনামি চিংড়ি চাষে তার মনে হয়েছে, এটি যদি সার্বজনীন চাষের সুযোগ হয় তাহলে মাছ কোম্পানিগুলোর কাঁচামালের অভাব দূর হবে। তিনি জানান, পাইলট প্রকল্পে প্রতি কেজি উৎপাদন ব্যয় হয়েছে তিনশ টাকার মতো। স্থানীয় বাজারে যা পাঁচশ টাকার ঊর্ধ্বে বিক্রি করা সম্ভব বলে তিনি দাবি করেন। পরীক্ষামূলক ভেনামি চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে প্রধান পরামর্শক, খুলনার মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ দফতরের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক প্রফুল্ল কুমার সরকার বলেন, এটি একটি বিদেশি প্রজাতির চিংড়ি মাছ। সারাবিশ্বে বাগদা চিংড়ির নিবিড় বা আধা নিবিড় চাষে বিপর্যয় নামলে বাড়তি সুবিধার জন্যে ভেনামী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ্বের ৬৫ থেকে ৭০টি দেশে এবং এশিয়ার ১৪টি দেশে চিংড়ি চাষ হয়। আমাদের দেশের ভৌগলিক অবস্থান ও আবহাওয়ায় ভেনামি চাষ সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরীক্ষামূলক চাষে দেখা গেছে দেশে প্রতি হেক্টরে ৯ থেকে ১০ মে. টন উৎপাদন সম্ভব। যেখানে একেবারে নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদা চাষ করা হলে তিন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ মে. টন উৎপাদন হয়। তাও সময় লাগে অন্তত দু’মাস বেশি। চাষি এবং চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা মালিকদের পক্ষ থেকে ভেনামি চাষের দাবি উঠলে সরকার এক পর্যায়ে এসে পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি দেয়। এর চাষ সার্বজনীন করা হলে বিশ^ বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সামনে নতুন দিগন্ত উম্মোচন হবে।
খুলনার মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ দফতরের উপপরিচালক মোহাম্মদ মজিনুর রহমান বলেন, পাইকগাছার লোনা পানি কেন্দ্রে চারটি পুকুরে পরীক্ষামূলক ভেনামি চিংড়ি চাষে আশাব্যাঞ্জক সফলতা পাওয়া গেছে। আধা নিবিড় পদ্ধতিতে এটি চাষ করলে হেক্টর প্রতি ১০ টন উৎপাদন সম্ভব। এতে হিমায়িত রফতানির জন্য কাঁচামালের সংকট দূর হবে এবং বৈদিশিক মুদ্রা আয়ও বাড়বে। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস্ এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মো. আব্দুল বাকী বলেন, বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষ করতে পারলে বন্ধ হওয়া চিংড়ি কোম্পানিগুলো আবারো চালু হবে। এ সেক্টরটি আবারো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। বাংলাদেশ এক সময় চিংড়ি রফতানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ছিল, এখন সপ্তমে নেমেছে। বিএফএফইএ’র পরিচালক ও আছিয়া সী ফুডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তারিকুল ইসলাম জহীর অভিযোগ করেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দেশে ভেনামি চাষ অনুমোদন পাচ্ছেনা। নানা খোঁড়া অজুহাতে একে বাঁধাগ্রস্থ করা হচ্ছে। এদিকে কোম্পানি মালিকরা কাঁচামালের অভাবে উৎপাদনে যেতে না পারলেও ব্যাংক লোনের সুদ দিচ্ছে, বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছে, অন্যান্য খরচ টানতে গিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। রফতানিমুখি এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে আর বিলম্ব না করে ভেনামি চাষের অনুমতি দিতে হবে। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস্ এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস, হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৭৮টি চিংড়ি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এখন কাগজে কলমে আছে ১০৫টি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিয়মিত রফতানি করছে মাত্র ৩০ থেকে ৪০টি।
সূত্র মতে, ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ (প্রাক্তন পশুসম্পদ) মন্ত্রীকে একটি পত্রের মাধ্যমে ভেনামি চিংড়ি সম্পর্কে অবগত করে। ২০১১ সালে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ (প্রাক্তন পশুসম্পদ) সচিবকে পত্র দিয়ে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি চাওয়া হয়। এর বাইরেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সভা, সেমিনার এবং ফোরামে ভেনামি চাষের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। ২০১৮ সালে ভেনামি চাষের অনুমতি মেলে। ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি চাষ প্রবর্তনের জন্য গঠিত কারিগরী কমিটি ‘খুলনা ও কক্সবাজার এলাকায় পৃথক পৃথকভাবে ১০-২০ একর আয়তনের সম্পূর্ণ আলাদা জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষের অনুমোদন দেয়। খুলনার পাইকগাছায় সুশীলন এবং কক্সবাজারে গোল্ডেন একুয়া শ্রিম্প হ্যাচারি লি: কে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়। ইন্টারনেটের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ার মধ্যে চিনে ভেনামি চাষ শুরু হয় ১৯৮৮ সালে, ফিলিপাইনে ১৯৯৭ সালে, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ায় ২০০০ সালে, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ২০০১ সালে, সিঙ্গাপুরে ২০০২ সালে, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০০৩ সালে, ইসরাইলে ২০০৪ সালে, ইরানে ২০০৬ সালে এবং সৌদী আরবে ২০০৮ সাল থেকে ভেনামি চিংড়ির চাষ শুরু হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশ শুধুমাত্র পরীক্ষামূলক উৎপাদনে সীমাবদ্ধ রয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তর ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে ৪৭ হাজার ৬৩৫ মেট্রিক টন হিমায়িত চিংড়ি রফতানি হলেও মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে তা নেমে এসেছে ৩০ হাজার ৩৬ মেট্রিক টনে। একইভাবে উল্লিখিত সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে ৩৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে আরও কমে ৩২৯ ডলারে ঠেকেছে। অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে ২ লাখ ১৬ হাজার ৪৬৮ হেক্টর জমিতে বাগদা চিংড়ির চাষ হয়েছিল। সেখানে ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে চাষ হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমিতে। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে কমেছে ৩১ হাজার ১৬০ হেক্টর জমি।