দুই কন্যার শৈশবে বিদেশ যাওয়া বাবা ১৬ বছর পর ফিরলেন কফিনে

0

মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল॥ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। হাসি-কান্নার সত্যিকার সহাবস্থান যেন দেখা যায় এখানে। বিদেশ থেকে আসা স্বজনদের গ্রহণে এখানকার আগমনী টার্মিনাল ফটকে যেমন থাকে আনন্দ-উচ্ছ্বাস, বিপরীতে বিদেশগামীদের বিদায়ের বহিগর্মন টার্মিনালের ফটকে দেখা যায় বিষাদ, অশ্রু, আবেগ। তবে এ বিষাদের চেয়েও আকাশভাঙা শোক থাকে বিমানবন্দরে। তাও আবার আগমনে। স্বজনের কফিনবন্দি হয়ে আগমনে। বিমানবন্দরের আগমনী টার্মিনালে যখন চলে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের অভ্যর্থনা, তখন এক পাশে চলে শোকের ‘অভ্যর্থনা’, কান্না-আহাজারি। শোকাতুর স্বজনরা অপেক্ষায় থাকেন প্রিয়জনকে গ্রহণের, শেষবারের মতো। বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) ভোরে বিমানবন্দরের আট নম্বর হ্যাঙ্গার গেটের বাইরে পায়চারী করছিলেন ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। ঢিলেঢালা হাফ হাতা শার্ট ও লুঙ্গি পরিহিত বৃদ্ধ একটু পরপর ঘড়ি দেখছিলেন। পাশে দাঁড়ানো তার সমবয়সী একজনের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছিলেন। দুজনের মুখই বেশ বিষণ্ন। সকাল সাড়ে ৭টার পর প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইনসহ গণমাধ্যমকর্মীদের হ্যাঙ্গার গেট এলাকায় জড়ো হতে দেখে বৃদ্ধ এগিয়ে এসে জানতে চান, ‘বাবা, এখানে এতো ভিড় কেন? এক গণমাধ্যমকর্মী উত্তর দেন, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট ক্যাপ্টেন নওশাদ কাইয়ুম, যিনি মধ্যাকাশে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ভারতের নাগপুরের হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন, তার মরদেহ আসবে’। এ কথা শুনতেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধ। তিনিও যে এখানে এসেছেন মরদেহের অপেক্ষায়। বাহরাইন থেকে তার ছেলের মরদেহ আসবে সকাল ৯টার ফ্লাইটে। সিলেটের গোয়াইনঘাট এলাকার এ বৃদ্ধের নাম হাবিবউল্লাহ। পেশায় কৃষক। চার বছর আগে তার ২০ বছর বয়সী ছেলে হাফিজউল্লাহকে চার লাখ টাকা খরচ করে ফ্রি ভিসায় বাহরাইনে পাঠান। জমি ও গরু বেঁচে এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ করে ওই চার লাখ টাকা জোগাড় করেন। সেখানে গিয়ে নির্মাণকাজে ভালোই আয়-রোজগার করছিলেন হাফিজ। কিন্তু গত সপ্তাহে একটি নির্মাণাধীন ভবনের দোতলা থেকে নিচে পড়ে মারা যান। সেখানে অবস্থানরত এক আত্মীয় ছেলের মৃত্যুর সংবাদ জানান হাবিবউল্লাহকে। কাঁদতে কাঁদতে হাবিবউল্লাহ বলেন, ‘ছেলেটা মৃত্যুর দিনও দুইবার মোবাইল ফোনে খবর নিয়েছে। সাতদিন ধরে তার নম্বর থেকে মোবাইল ফোন আসে না।’ বলতে বলতেই যেন আরও বুক ফেটে কান্না আসে তার। হাবিবউল্লাহ বলেন, ছেলের মরদেহ আনতে এক লাখ টাকার মতো প্লেন খরচ দিতে হয়েছে।
অদূরে ফুটপাতের রাস্তায় বসেছিল দুই কিশোরী। তাদের মুখেও হাসি নেই। কৈশোরে যে চাঞ্চল্য থাকার কথা, নেই তার লেশমাত্রও। দুজনেরই মুখ ভার। সামনে এগিয়ে কথা বলে জানা যায়, তারা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থেকে এসেছে। তাদের বাবা নাজিমউদ্দিন ১৬ বছর আগে সৌদি আরবে যান। সম্প্রতি তিনি সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। ধরা গলায়ই দুই কিশোরী জানায়, খুব ছোট থাকতে তাদের বাবা সৌদি আরব চলে যাওয়ায় কখনো সামনা-সামনি দেখা হয়নি। সরাসরি আদর মেলেনি। তবে মোবাইলে কথা হতো। ছুটির সুযোগ থাকলেও কেন তিনি বেড়াতে আসেননি জানতে চাইলে ওই দুই কিশোরী জানায়, দেশে এলে উড়োজাহাজ ভাড়া, সন্তান ও স্বজনদের জন্য কেনাকাটায় অনেক টাকা খরচ হবে ভেবে বিদেশেই থেকে যেতেন নাজিমউদ্দিন। কথা ছিল এবার করোনা মহামারি শেষ হলে তিনি দেশে আসবেন। কিন্তু এলেন, তবে কফিনে মুড়ে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দেশ থেকে ফ্লাইটে একাধিক বাংলাদেশির মরদেহ আসে। স্বজনরা উপস্থিত হয়ে মরদেহ গ্রহণ করেন। এ মরদেহ হস্তান্তরকালে অনেক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জানা গেছে, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রবাসী কর্মীদের মরদেহ দাফন-কাফনের জন্য বিমানবন্দরেই ৩৫ হাজার টাকা দেয়া হয়। পরে তাদের পরিবারকে আরও তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।