যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য বিস্তারের দিন কি শেষ হয়ে আসছে?

0

লোকসমাজ ডেক্স॥ আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের পক্ষে জোর গলায় যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘অন্য আরেকটি দেশ পুনর্নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রয়োগের যুগের’ অবসান ঘটানোর কথা ঘোষণা করেছেন। ১১ সেপ্টেম্বর-পরবর্তী বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির কথা তুলে ধরতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে তার ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং কোনো যুদ্ধে যাওয়ার আগে পরিষ্কার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। তবে জাতি কিম্বা রাষ্ট্র গঠনে তার দেশ আর জড়িত হবে না। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, তিনি স্থলযুদ্ধ পরিহার করবেন। কোনো দেশে বিশাল সৈন্য বাহিনী মোতায়েনের পরিবর্তে তিনি জোর দেবেন কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, হুমকি মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রকে এখন অর্থনৈতিক ও সাইবার নিরাপত্তার প্রতিযোগিতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি মনে করেন, বিশাল সৈন্য বাহিনী পাঠিয়ে, যেমনটা আফগানিস্তানে করা হয়েছে, সে রকম না করে বরং সামরিক প্রযুক্তির সাহায্যে সন্ত্রাসীদের মোকাবেলা করতে হবে। তার ভাষায়, ‘অন্য কোনো দেশের মাটিতে এখন আর সৈন্যদের পা ফেলার প্রয়োজন নেই।’ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার ২০তম বার্ষিকীর মাত্র ১১ দিন আগে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার ভাষণে এসব কথা ঘোষণা করেন। ওই হামলার জের ধরেই আমেরিকা আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল।
আমেরিকা কি আর যুদ্ধে জড়াবে না?
যুক্তরাষ্ট্রের যখন তখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে দেশের ভেতরে তাত্ত্বিক আলোচনা চলছে। কথাবার্তা হচ্ছে নীতি নির্ধারণী পর্যায়েও। বিশেষ করে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ছাড়া রাষ্ট্র কিম্বা জাতি গঠনের ব্যাপারে দেশটির যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার কথা বলা হচ্ছিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার শাসনামলে যুদ্ধ-কবলিত বিভিন্ন দেশ থেকে সৈন্যদের ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এ বিষয়ে আফগানিস্তানের তালেবানের সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছান। প্রেসিডেন্ট বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে এনেছেন এবং বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত শুধু আফগানিস্তানের বিষয়ে নয়, এই সিদ্ধান্ত অন্য কোনো দেশ পুনর্গঠনে সামরিক অভিযান অবসানের ব্যাপারেও।’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট ভবিষ্যতে জাতীয় স্বার্থ ছাড়া যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের শিক্ষক ড. আলী রীয়াজ মনে করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো যুদ্ধে জড়িত হবে না- এ রকমটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, ‘জো বাইডেন বলেছেন মানবাধিকার রক্ষার জন্য তার দেশ অন্তহীন কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সবসময় সচেষ্ট থাকবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’ আলী রীয়াজ বলেন, সামরিক শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হবে সেখানে জাতীয় স্বার্থ কতোটুকু আছে এবং তাতে অন্যদের সংশ্লিষ্ট করা যায় কীনা। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও বলেছেন, কেউ জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে তাকে শায়েস্তা করা হবে। তার মতে জাতীয় নিরাপত্তার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করলেও কয়েক বছর পর থেকে এই যুদ্ধের সাথে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে এই যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়েছে। তার মতে, এই লড়াই ছিল আসলে দু’টো আঞ্চলিক শক্তি ভারত ও পাকিস্তানের লড়াই। ‘সেটা কেন যুক্তরাষ্ট্র করতে গেল?’ ‘যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি ভূমিকা রাখবে না বিষয়টা এমন নয়। তবে এটি আর প্রধান হয়ে উঠবে না। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার কথাও প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন। তবে সেটা সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, তিনি অন্যদের সাথে নিয়ে এ বিষয়ে কাজ করার কথা বলেছেন।’ যুক্তরাষ্ট্রের আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাউথ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক শফিকুর রহমান মনে করেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই ঘোষণা রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বলেন, ‘মনে রাখতে হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন আফগানিস্তান যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি সেটাই পূরণ করেছেন। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রয়োগ কতোটা বন্ধ করতে পারবেন এ বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এর পেছনে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কিছু কারণ রয়েছে। দেশটির সামরিক শিল্প বিরাট ভূমিকা পালন করে আমেরিকার অর্থনীতিতে। গত ২০ বছরে তারা ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। ৫০ লাখেরও বেশি লোক এই শিল্পের সাথে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র যদি সামরিক ভূমিকা না রাখে তাহলে দেশটির অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। তিনি বলেছেন, আমেরিকার প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের সামরিক বাজেট থেকে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পেয়ে থাকে। এসব স্টেটের চাপের কারণেও প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পক্ষে সামরিক শক্তি প্রয়োগ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এর পেছনে আন্তর্জাতিক কারণও রয়েছে। প্রতিরক্ষা জোট নেটো, কোরিয়া, জাপান, ইসরাইল, সৌদি আরব, ব্রাজিল, দক্ষিণ আমেরিকা, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ ও জোটের সাথে আমেরিকা নানা ধরনের সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তাদের সামরিক স্বার্থের দিকেও যুক্তরাষ্ট্রকে নজর দিতে হবে।
নতুন যুগ?
প্রেসিডেন্ট বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে ‘নতুন যুগ’ বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন তার আগের তিনজন প্রেসিডেন্ট যেভাবে আফগানিস্তান এবং ইরাক পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করেছেন সেরকম করার আর কোনো অবকাশ নেই। আমি চতুর্থ প্রেসিডেন্ট যাকে আফগানিস্তান যুদ্ধ শেষ করা হবে কীনা, হলে কখন করা হবে এই বিষয়টির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের যেমন পরিবর্তন ঘটেছে তেমনি তার সাথে তাল মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকেও বদলাতে হবে। আফগানিস্তান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর, আরো কয়েকটি দেশে যুদ্ধ করতে গেছে। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়ায় চালানো সামরিক অভিযান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একদিকে ছিল ব্যয়বহুল, অন্যদিকে বহু আমেরিকান সৈন্যকেও এসব যুদ্ধে প্রাণ দিতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজেও আবেগপূর্ণ ভাষায় বলেছেন, অনেকেই অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন, কারো মস্তিষ্কে আঘাত লেগেছে, মানসিক প্রভাবও পড়েছে, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে, প্রতিদিন গড়ে ১৮ জন সৈন্য আত্মহত্যা করেছেন। শুধুমাত্র আফগানিস্তান যুদ্ধেই দেশটির খরচ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি ডলার। নিহত হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৫০০ মার্কিন সৈন্য। যুক্তরাষ্ট্রে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এক হিসেবে বলা হচ্ছে, ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান ও সিরিয়াতে যুদ্ধ-বাবদ যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে প্রায় ছয় ট্রিলিয়ান ডলার। বিবিসির উত্তর আমেরিকা বিষয়ক সংবাদদাতা অ্যান্থনি জুরকার বলছেন, জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে আমেরিকানরা আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহারকে সমর্থন করছেন। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেভাবে সেটি সম্পন্ন করেছেন তাতে তারা খুশি নন। হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তারা আশা করছেন সময় অতিবাহিত হলে, যুদ্ধ কীভাবে শেষ হয়েছে তার খুঁটিনাটি ভুলে গিয়ে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই কাজের জন্য আমেরিকা কৃতজ্ঞ থাকবে। তবে শফিকুর রহমান মনে করেন আফগানিস্তান থেকে সৈন্যদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে সেটা আড়াল করার জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন সামরিক শক্তি প্রয়োগের অবসানের ঘোষণা দিয়ে থাকতে পারেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতি ছিল অন্য দেশ থেকে সৈন্যদের ফিরিয়ে আনা, অন্য কোনো দেশে সামরিক অবকাঠামো গড়ে না তোলা। এর ফলে যে অর্থের সাশ্রয় ঘটবে সেটা তিনি আমেরিকার ভেতরে খরচ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় শিবিরের সমর্থকদের কাছেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। আগামী বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে ভোটারদের কথা বিবেচনা করে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকেও এখন একই ধরনের বক্তব্য দিতে হয়েছে।
বদলে যাচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি
দীর্ঘ দুই দশকের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করে শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ৩১ অগাস্ট মঙ্গলবার গভীর রাতে সৈন্য প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই আফগানিস্তান থেকে নিজেদের শেষ সৈন্য ও কূটনীতিককে কাবুল থেকে তুলে নিয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সৈন্য প্রত্যাহারের এই প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনার মধ্যেই সেনা প্রত্যাহারের একদিন পর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। জো বাইডেন বলেছেন, যুদ্ধ শেষ করার এই সিদ্ধান্তের জন্য আমেরিকার জনগণ তাকে মনে রাখবে এবং যেভাবে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে সেটা আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেছে। উত্তর আমেরিকায় বিবিসির সংবাদদাতা অ্যান্থনি জুরকার লিখেছেন, গত ২০ বছর ধরে আমেরিকা যে একটি দেশ দখল করে সেটি পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করে আসছিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘সেই পাতা উল্টে’ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সাংবাদিক জুরকার লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিকে তিনি নতুন করে সাজাতে চেষ্টা করছেন। সামরিক বাহিনী মোতায়েনের বদলে তিনি বরং কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর জোর দিতে চান। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আলী রীয়াজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে ইতোমধ্যেই পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এককভাবে কাজ করতেন যা এখন আর নেই। এখন সারা বিশ্বে বিভিন্ন রকম শক্তির উত্থান ঘটেছে। চীনের উত্থান হয়েছে। ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে রাশিয়ার উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এই বাস্তবতার নিরিখেই যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করছে।’ তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ৬০-এর দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যেভাবে আচরণ করে আসছে, সারা বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের নতুন বাস্তবতার কারণে সেখানে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাউথ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক শফিকুর রহমানও মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘একলা চলো’ নীতির কারণে আমেরিকার নেতৃত্ব নিয়ে ইউরোপ ও নেটো বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখন সেখানে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন। তারা বুঝতে পারছিল না কোথায় যাবে। জার্মানি রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক করছিল। ইসরাইল সম্পর্ক গড়ে তুলছিল চীনের সাথে। এরকম একটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজেদের বের করে আনার চেষ্টা করছেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, আমেরিকাকে এখন অন্য বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আফগানিস্তান যুদ্ধ শেষ হওয়ার কারণে আমেরিকা এখন চীন ও রাশিয়ার ব্যাপারে আরো বেশি মনোযোগ দিতে পারবে। তিনি বলেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব আমেরিকাকে রক্ষা করা। ২০০১ সালের হুমকির বিরুদ্ধে নয়, বরং ২০২১ সাল এবং ভবিষ্যতের হুমকি মোকাবেলা করাই তার কাজ। জো বাইডেন বলেন, আফগানিস্তানসহ অন্যান্য দেশে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের লড়াই অব্যাহত থাকবে। তবে ‘এজন্য স্থলযুদ্ধে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। শফিকুর রহমান মনে করেন, প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই। ‘তিনি আর তিন বছর থাকবেন। এর পর কী হবে আমরা জানি না। বাকি তিন বছরে তিনি কতোটুকু কী করতে পারবেন সেটাও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তাহলে কী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের আগের ভূমিকা আর থাকবে না? আলী রীয়াজ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের মতোই থাকবে, তবে ভিন্ন উপায়ে। ‘সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর নিজেকে নেতৃত্বের আসনে রাখতে পারছে না, পারবেও না, প্রয়োজনও নেই। তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে নিজেকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে এবং তার মিত্রদের সাথে নিয়ে। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব অব্যাহত থাকবে। তবে সেটি এককভাবে বা সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হবে না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর থেকে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে দেশটি ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান-যেখানেই যুদ্ধে জড়িয়েছে তার কোনোটিতেই তারা সফল হতে পারেনি। আলী রীয়াজ মনে করেন এ কারণে জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার যে ধারা তৈরি হয়েছিল সেখান থেকে তারা সরে আসবে। তাহলে কি সামরিক শক্তির বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের সুপার-পাওয়ার ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে? এই প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরেও তাই মনে করা হয়েছিল। আরো কিছু যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার পরেও এরকম ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তবে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই ইমেজে কোনো পরিবর্তন আসবে কীনা সেটা নির্ভর করছে বিশ্ব ব্যবস্থার বাস্তবতা অনুযায়ী দেশটি তার ভূমিকা নির্ধারণ করতে পারছে কীনা তার ওপর।’ শফিকুর রহমানও মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সুপার-পাওয়ার’ ইমেজ পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। ‘সারা বিশ্বে আমেরিকার সম্মান, নেতৃত্ব, ব্যবসা বাণিজ্য, অভিভাবকত্ব, আমরা বড় ভাই-এই ধারণা, তাদের ওপর নির্ভর করা যায়-ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, পূর্ব এশিয়ার বহু দেশ তো তাকিয়েই থাকে আমেরিকার দিকে। আর এ সবই তো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির কারণে। এই শক্তি প্রদর্শন না করলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমেরিকার সেই নেতৃত্বও থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গত ৭০ বছরে বিশ্বে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে আমেরিকার একটি ইমেজ তৈরি হয়েছে। এই ইমেজ রক্ষা করতে হলে তাকে অবশ্যই সামরিক শক্তি দেখাতে হবে। অন্যথায় সবাই মনে করবে আমেরিকা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। বাকি বিশ্বের এই ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হবে।’
সূত্র : বিবিসি