সুন্দর সাহা॥ আন্তঃদেশীয় অস্ত্র ও সোনা পাচারকারী সিন্ডিকেটের প্রধান দুর্ধর্ষ আকুল হোসেন (৩৬)সহ ৫জন কুখ্যাত অপরাধীেক ঢাকা ডিবি পুলিশ আটক করেছে। এসময় এদের কাছ থেকে আটটি বিদেশী পিস্তল, আট রাউন্ড গুলি এবং ১৬টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করেছে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, সীমান্ত শহর বেনাপোলের বহু অপকর্মের হোতা এই আকুল হোসেন শার্শা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি বলে জানা গেছে। সাপের বিষ, অস্ত্র ও সোনা চোরাচালানের পাশাপাশি আকুল এবং আজিম উদ্দীনসহ তার বাহিনীর সদস্যরা তক্ষক প্রতারণা, সীমান্ত পিলার, গোল্ড স্মাগলিং, প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তি, ইয়াবা ও আইস মাদক কারবারেও জড়িত বলে পুলিশসহ সীমান্তের সূত্রগুলো জানায়। এই চক্রটি ভারত থেকে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় কেনা অবৈধ অস্ত্র নিয়ে সীমান্তের নিরাপত্তা বাহিনীর নজর এড়িয়ে ঢুকতো বাংলাদেশে। দেশে এনে সেগুলো দ্বিগুণ দামে অর্থাৎ ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করতো ।
এসব অস্ত্র বাংলাদেশে বিভিন্ন সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির কাজে ব্যবহোর হতো। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত এভাবেই দুই শতাধিক অবৈধ অস্ত্র ভারত থেকে বাংলাদেশে এনে বিক্রি করেছে আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাকারবারি দলের সদস্যরা। এমনই একটি চক্রের পাঁচ অস্ত্র চোরাকারবারিকে বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগ। রাজধানীর মিরপুর, দারুস সালাম ও গাবতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে আটটি বিদেশি পিস্তল, আট রাউন্ড গুলি, ১৬টি ম্যাগাজিন ও একটি প্রাইভেটকার জব্দ করে ডিবি। আন্তঃদেশীয় অস্ত্র ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের প্রধান আকুল হোসেনসহ গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলেন, ইলিয়াস হোসেন, আব্দুল আজিম, মিলন হোসেন ও ফজলুর রহমান। তারা সবাই যশোরের বেনাপোল ও শার্শা থানা এলাকার বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে তাদের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত তুলে ধরেন ডিবিপ্রধান অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি ডিবির গুলশান বিভাগ বিভিন্ন অপরাধীর কাছ থেকে বেশ কয়েকটি অবৈধ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে।
এ
ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো তদন্তকালে জানা যায়, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীর একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা যশোরের বেনাপোল থেকে অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ করে।এছাড়া তারা দেশে অপরাধীদের কাছে অস্ত্র-গুলি সরবরাহ করছে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়ে বেনাপোল এলাকার কে বা কারা এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তা তদন্তে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়।’ ‘তদন্তের এক পর্যায়ে গোয়েন্দা তথ্য ও তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে গোয়েন্দা (গুলশান) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমানের নেতৃত্বে বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
আন্তর্জাতিক অস্ত্র বেচা-কেনা দলের সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি নিয়ে অপরাধীদের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রাইভেটকারযোগে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড হয়ে ঢাকায় ঢুকবে- এমন সংবাদের ভিত্তিতে ডিবি গুলশান বিভাগের তিনটি টিম দারুসসালাম থানা এলাকার দিয়াবাড়ীগামী রাস্তা, বেড়িবাঁধগামী রাস্তা ও কল্যাণপুরগামী রাস্তায় ওঁৎ পেতে থাকে।’
হাফিজ আক্তার জানান, এরপর রাত আনুমানিক সোয়া ৩টার দিকে গাবতলী ব্রিজের ইউলুপ দিয়ে সন্দেহজনকভাবে একটি সিলভার রংয়ের প্রাইভেটকার দ্রুতগতিতে উত্তর দিকে অগ্রসর হলে দিয়াবাড়ী টিমকে রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে বলা হয়। এসময় অন্য টিমগুলোও প্রাইভেটকারটির পেছনে ধাওয়া করে। ডিবি সদস্যরা স্থানীয়দের সহায়তায় রাস্তায় চলাচলরত গাড়ি দিয়ে দারুস সালাম থানাধীন বেড়িবাঁধ বড় বাজারস্থ আক্তার হাজীর মাংসের দোকানের সামনে পাকা রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করে। ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার জানান, জ্যামে আটকা পড়া গাড়িটিকে ডিবি পুলিশের সদস্যরা স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় ঘিরে ফেললে প্রাইভেটকারটির চালক ও পেছনের সিটের একজন লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখন তাদের ধরে ফেলা হয়। ডিবির অপর সদস্যরা স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে গাড়িতে অবস্থানরত অপর তিনজনকে ধরে ফেলেন। এসময় তাদের তল্লাশি করে আকুল হোসেনের কোমরের পেছনে প্যান্টে গোঁজা অবস্থায় এক রাউন্ড গুলিভর্তি একটি বিদেশি পিস্তল ও গলায় ঝুলিয়ে রাখা একটি হ্যান্ডব্যাগে পাঁচটি বিদেশি পিস্তল, পাঁচ রাউন্ড গুলি, আটটি খালি ম্যাগাজিন; আব্দুল আজিমের কোমরের পেছনে গোঁজা অবস্থায় এক রাউন্ড গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল; ইলিয়াস হোসেনের কোমরের পেছনে প্যান্টে গোঁজা অবস্থায় এক রাউন্ড গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল; অবৈধ অস্ত্র বেচা-কেনার সহযোগী মিলন হোসেন এবং গাড়িচালক ফজলুর রহমানকে একটি প্রাইভেট কারসহ গ্রেফতার করা হয়।
এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, গোয়েন্দা (গুলশান) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমানের নির্দেশনায় অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. কামরুজ্জামান সরদারের তত্ত্বাবধানে এডিসি মাহবুবুল হক সজীবের নেতৃত্বে অভিযানটি পরিচালিত হয়। গ্রেফতার ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে ডিবি প্রধান বলেন, ‘চক্রটির মূলহোতা আকুল নিজে বা তার বিশ্বস্ত লোকজনের মাধ্যমে বেনাপোল সীমান্ত এলাকা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সেগুলো সরবরাহ করছিলেন। আকুল ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক অবৈধ অস্ত্র নিজে বিক্রি করেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘অস্ত্র চোরাচালানসহ চক্রের সদস্যরা তক্ষক প্রতারণা, সীমান্ত পিলার, সাপের বিষ, গোল্ড স্মাগলিং, প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তি, ইয়াবা ও আইস-মাদক কারবারেও জড়িত ছিলো।’ ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘চক্রটি ভারত থেকে ৫০ হাজার টাকায় কেনা অস্ত্র বাংলাদেশে এনে বিক্রি করতো ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায়। এসব অস্ত্র ভারত থেকে সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে আনা হতো। যেগুলো দিয়ে দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বিশেষ করে চাঁদাবাজির জন্য এসব অস্ত্র কেনা হতো বলে জানিয়েছেন চক্রের সদস্যরা।’ সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, ‘ভারতে তৈরি এসব অবৈধ অস্ত্র ২৮ থেকে ৫০ হাজার টাকায় কিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন পার্টির কাছে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করতো চক্রের লোকেরা।’
আকুল হোসাইন বেনাপোল পোর্ট থানাস্থ ঘিবা গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে। আর আকুলের সাথে অস্ত্রসহ যে চার সহযোগী আটক হয়েছেন তারা হলেন, বেনাপোল পোর্ট থানার দূর্গাপুর গ্রামের মৃত ইহান আলীর ছেলে আজীম উদ্দীন (২৮), বড় আঁচড়া গ্রামের আমির আলীর ছেলে ইলিয়াছ হোসেন (৩১), বেনাপোলের বোয়ালিয়া গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে ফারুক হোসেন মিলন (২৮) ও ভবেরবেড় গ্রামের আজিবর রহমানের ছেলে ফজলুর রহমান (৩৫) । আটককৃতদের বিরুদ্ধে ডিএমপি এর দারুস সালাম থানায় মামলা হয়েছে। যার নম্বর- ২/২৮৯, তারিখ-০১ সেপ্টে:-২০২১, ধারা ১৯ এ ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন। এসময় তাদের কাছ থেকে ব্যবহৃত ৮টি মোবাইলফোন ও একটি সিলভার রঙেয় প্রাইভেট কার জব্দ করা হয়েছে। যার নং- ঢাকা মেট্রো-গ-২৭-৩৫৮০। আকুল হোসাইনসহ তার আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ী পাঁচ সহযোগীকে আটকের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং মোবাইল ট্র্যাকিং ও কললিস্ট নিয়ে তদন্ত করা হয়েছে। আকুলের অস্ত্র ও স্বর্ণ চোরাচালানের আরও সহযোগীদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের তৎপরতাও শুরু হয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানায়।
এদিকে, ঢাকায় অস্ত্র গুলিসহ আটক যশোরের শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আকুল হোসাইন সম্পর্কে সভাপতি আব্দুর রহিম সরদার বলেছেন, সে (আকুল) অন্যায়কারী, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, অস্ত্র ব্যবসায়ী, আল্লাহরব্বুলআলামিন তাকে সঠিক শাস্তি দিয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদককে আটকের বিষয়ে আব্দুর রহিমের অভিমত জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে মোবাইল ফোনে উপর্যুক্ত কথা বলেন তিনি। অপরদিকে আকুলের স্ত্রী একই দিন সন্ধ্যায় প্রেসক্লাব যশোরে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, কোন ‘স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ নিয়ে পুলিশ তাদের ফাঁসাতে চাইছে’। উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ২০১২ সালের ৩ মে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আরিফুল ইসলাম রিয়াদ ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বিপুলসহ জেলা থেকে সাত নেতা শার্শায় এসে তাকে ( রহিমকে) সভাপতি ও ইকবাল হোসেন রাসেলকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করেন। কিন্তু এরপর যশোরে ফিরে গিয়ে আনোয়ার হোসেন বিপুল ফের কমিটির ঘোষণা দেন। ওই কমিটিতে তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে ইকবাল হোসেন রাসেলকে বাদ দিয়ে আকুল হোসাইনকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন। কিন্তু আকুলকে ওই পদে শার্শা উপজেলা শাখা, ৯টি ইউনিয়ন শাখা ও তিনটি কলেজ শাখার কেউ এখনও সেক্রেটারি হিসেবে মানেনি।

অপরদিকে আটক আকুল হোসাইনের স্ত্রী নাদিরা আক্তার লাইজু এ দিন সন্ধ্যায় প্রেসক্লাব যশোরে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, “আমরা চ্যালেঞ্জ করে বলছি, আকুল তার ব্যবসায়িক বন্ধুদের নিয়ে খুলনায় যাচ্ছিলেন। এসময় তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ নিয়ে পুলিশ তাদের ফাঁসাতে চাইছে। আমরা জানতে পেরেছি ডিবি পুলিশের গুলশান জোন ডিসি মশিউর রহমান ও এডিসি কামরুজ্জামান তাকে খুলনা থেকে তুলে ঢাকায় নিয়ে যান। পরে অস্ত্রসহ আটকের মিথ্যা নাটক সাজানো হচ্ছে।” এবিষয়ে বেরাপোল পোর্ট থানার ওসি মামুন খান জানান, “বেনাপোল পোর্ট থানায় আকুলের নামে দ্রুত বিচার আইনে, বিস্ফোরক আইনে, চাঁদাবাজী এবং মারামারির চারটি মামলা রয়েছে।” আকুলের নামে বেনাপোল পোর্ট থানায় যে ৪টি মামলা রয়েছে। তা হলো:-মামলা নং ০১, তারিখ ০১ জুলাই ২০১৪ সাল, মামলা নং-১৭, তারিখ ১৭ ফেব্রæয়ারি-২০১৬সাল, মামলা নং ১৮, তারিখ- ৮জুলাই-২০১৭ সাল, দ্রæত বিচার আইনে মামলা নং ২৮, তারিখ-৭ সেপ্টেম্বর-২০১৮ সাল। এছাড়া ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙচুর ও আকুলের বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণের অস্ত্র উদ্ধারের মামলা ছিলো। তবে তা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, “আকুল হোসেন তার বাহিনী নিয়ে বিভিন্ন স্থানে সোনা এবং হুন্ডির টাকা কেড়ে নেয়াসহ চাঁদাবাজিতে জড়িত ছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু এসব বিষয়ে কেউ থানায় কোন অভিযোগ না করায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি।





