খুলনা বিভাগে বোরো সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ

0

সুন্দর সাহা ॥ খুলনা বিভাগে চলতি বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। সারা দেশে চলতি বোরো ধান-চাল খাদ্য সংগ্রহের লক্ষামাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৫ হাজার ১৮৫ মেট্রিক টন ও বোরো চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৪৭ হাজার ২০৫ মেট্রিক টন। কৃষকদের কাছ থেকে গত ২৮ এপ্রিল থেকে বোরো ধান ২৭ টাকা কেজি দরে এবং মিলারদের কাছ থেকে ৭ মে থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহ শুরু হয়। গত ৩১ আগস্ট ছিল সংগ্রহের শেষ দিন। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়নি। টার্গেটের বিপরীতে খুলনা বিভাগে অর্জিত হয়েছে ধান মাত্র ৬৪ শতাংশ এবং চাল ৯৩ শতাংশ। এবার ২৭ টাকা কেজি দরে ধান, ৪০ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল ও ৩৯ টাকা কেজি দরে আতপ চাল কেনার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়। গত বছর বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ধান, ৩৭ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল ও ৩৬ টাকা কেজি দরে আতপ চাল কেনার দাম নির্ধারিত ছিল। চলতি মৌসুমে দাম বৃদ্ধির পরও সফল হয়নি সংগ্রহ অভিযান।
খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য অধিদফতরের দেয়া তথ্যে জানা যায়, খুলনা বিভাগের ১০ জেলার বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৫ হাজার ১৮৫ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে অর্জিত হয়েছে মাত্র মাত্র ৫৪ হাজার ৬৭৮ মে. টন ধান। অর্থাৎ তিন ভাগের দুই ভাগ অর্জিত হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ হাজার ৫০৭ মেট্রিক টন ধান কম সংগৃহিত হয়েছে। অপরদিকে ১ লাখ ৪৭ হাজার ২০৫ মেট্রিক টন বোরো চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হলেও মেয়াদ শেষে এই ১০ জেলায় অর্জিত হয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪২৯ মেট্রিক টন চাল। এই বিভাগের শুধুমাত্র মাগুরা জেলায় নির্ধারিত টার্গেট অর্জিত হয়েছে। মাগুরা জেলায় টার্গেট ছিল ৪ হাজার ৯৫ মেট্রিক টন ধান। অর্জিত হয়েছে ৫ হাজার ১৯৫ মেট্রিক টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল ৪ হাজার ৩৫৯ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে ৫ হাজার ২০৩ মেট্রিক টন। এছাড়া নড়াইল ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় চাল সংগ্রহের টার্গেট অর্জিত হয়েছে। নড়াইল জেলায় টার্গেট ছিল ৬ হাজার ৯৫৭ মেট্রিক টন ধান। অর্জিত হয়েছে ৩ হাজার ৯০৪ মেট্রিক টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল ৪ হাজার ৩১২ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে ৪ হাজার ৩৫৩ মেট্রিক টন। চুয়াডাঙ্গা জেলায় টার্গেট ছিল ৪ হাজার ৭৯৬ মেট্রিক টন ধান। অর্জিত হয়েছে ৩ হাজার ৭৫৪ মেট্রিক টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল ৭ হাজার ৬৮২ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে ৭ হাজার ৮৪১ মেট্রিক টন। এছাড়া বাকি আটটি জেলার মধ্যে যশোর জেলায় টার্গেট ছিল ২১ হাজার ৮৭৯ মেট্রিক টন ধান। অর্জিত হয়েছে ৮ হাজার ৫৮৫ মেট্রিক টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল ২৬ হাজার ২০২ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে ২৪ হাজার ৫৮১ মেট্রিক টন। খুলনা জেলায় টার্গেট ছিল ৮ হাজার ৯৫৭ মেট্রিক টন ধান। অর্জিত হয়েছে ৩ হাজার ৫৮১ মেট্রিক টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল ১৯ হাজার ৭০১ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে ১৯ হাজার ৭২৮ মেট্রিক টন। সাতক্ষীরা জেলায় টার্গেট ছিল ১০ হাজার ৯০২ মেট্রিক টন ধান। অর্জিত হয়েছে ৯ হাজার ৭৩৫ মেট্রিক টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল ১৫ হাজার ৫৯১ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে ১৫ হাজার ৭০৪ মেট্রিক টন। বাগেরহাট জেলায় টার্গেট ছিল ৮ হাজার ৫৩০ মেট্রিক টন ধান। অর্জিত হয়েছে ৬ হাজার ৭৩৭ মেট্রিক টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল ৬ হাজার ১৬৬ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে ৬ হাজার ৬৭ মেট্রিক টন। ঝিনাইদহ জেলায় টার্গেট ছিল ১১ হাজার ৪৫৯ মেট্রিক টন ধান। অর্জিত হয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৬০৭ মেট্রিক টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল ১৭ হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে ১৫ হাজার ৩৯ মেট্রিক টন। কুষ্টিয়া জেলায় টার্গেট ছিল ৪ হাজার ৯৭৭ মেট্রিক টন ধান। অর্জিত হয়েছে মাত্র এক হাজার ২৭৮ মেট্রিক টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল ৩৯ হাজার ৭১১ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে ৩৯ হাজার ৬৫৯ মেট্রিক টন। মেহেরপুর জেলায় টার্গেট ছিল ২ হাজার ৬৩৩ মেট্রিক টন ধান। অর্জিত হয়েছে ২ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল এক হাজার ৩৪২ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে এক হাজার ২৫০ মেট্রিক টন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, খোলাবাজারে এবার ধানের দাম বেশি। ফলে চাষিরা গুদামে ধান দেননি। সাম্প্রতিককালে চালের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। চাল সরবরাহে মিল মালিকরা সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছেন। মিল মালিকরা বাজার থেকে ধান কিনে চাল তৈরি করেছেন। এ কারণে বেড়ে যায় বোরো ধানের দাম। যে কারণে চাষিরা খাদ্য গুদামে ধান না দিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন। ফলে খাদ্য বিভাগের বোরো ধান সংগ্রহ অভিযান মুখ থুবড়ে পড়েছে। সরকারি মূল্যের চেয়ে বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ায় অনেক মিলার চুক্তি করেননি। আবার অনেক মিলার চুক্তি করেও সরকারি গুদামে চাল দিতে পারেননি। মিলার ও পাইকাররা সিন্ডিকেট করে বাজারে চালের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতার কারণেই এবারে বোরো ধান-চাল সংগ্রহের টার্গেট পূরণ হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে, চুক্তি করেও যেসব মিলার ধান-চাল দেননি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে ইতিমধ্যে চিঠি দিয়েছেন খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক। চিঠিতে বলা হয়, যেসব চালকল মালিক সরকারের সঙ্গে চুক্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্য আদিষ্ট হয়েও যেসব চালকল মালিক চুক্তি সম্পাদন করেননি তাদের লাইসেন্স স্থগিতের বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। আর যেসব চালকল মালিক চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ ব্যর্থ হয়েছেন ও সরকারি সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জনে অসহযোগিতা করছেন-সংগ্রহ মৌসুম শেষ হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে চুক্তিপত্র ও চালকল লাইসেন্স ইস্যু সংক্রান্ত বিধিবিধানসহ প্রাসঙ্গিক আইনি বিধি অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক একেএম লায়েক আলী বলেন, ‘করোনার ছাড়াও প্রতিকূল পরিস্থিতিই এবার ধান চাল সংগ্রহে বড় বাধা ছিল। বাজারে ধানের স্বল্পতা ছিল। বাজার থেকে চাল কিনে গুদামে দিলে আমাদের কেজিপ্রতি ৪ টাকা লোকসান দিতে হতো। এখন সরকার যদি মিলারাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়, চুক্তি অনুযায়ী তা নিতেই পারে। তবে সংগ্রহের সময়সীমা ১৫ দিন বাড়িয়ে দিলে মিলাররা চুক্তির চাল গুদামে সরবরাহ করতে পারতেন।’
এ বিষয়ে যশোর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অন্যান্য জেলার তুলনায় যশোর জেলায় বেশি চাল সংগ্রহ হয়েছে দাবি করে লোকসমাজকে জানান, যশোর জেলায় চাল সংগ্রহের টার্গেট ছিল ২৬ হাজার ২০২ মেট্রিক টন, সংগ্রহ হয়েছে ২৪ হাজার ৫৮১ দশমিক ৪৬ মেট্রিক টন। তবে ধান সংগ্রহ অভিযানে তেমন সাড়া মেলেনি। ধান সংগ্রহের ২১ হাজার ৮৭৯ মেট্রিক টন টার্গেটের বিপরীতে অর্জিত হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৫৫৮ দশমিক ৩৬ মেট্রিক টন। সময় কিছুটা বাড়িয়ে দিলে চালের টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হতো।
এ ব্যাপারে খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহবুবুর রহমান খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে জানান, মিলারদের সাথে চুক্তি সম্পাদনের পরই হঠাৎ করে ধান-চালের দাম বেড়ে যায়। তাছাড়া করোনার ভাইরাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পরিবেশ সংগ্রহ অভিযানের অনুকূলে ছিল না। তারপরও এই বিভাগে প্রায় ৯৩ শতাংশ চাল এবং ৬৪ শতাংশ ধান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
এ বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (সংগ্রহ) মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বোরো সংগ্রহ অভিযান সফল হয়নি তেমনটি বলা যাবে না। কারণ, আমাদের মূল যে টার্গেট ছিল সেটি পূরণ হয়েছে। বাকি যেটা হয়নি সেটা ছিল আনুসঙ্গিক মাত্র।’
খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যোগযোগ করা হলেও মুঠোফোনে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ডিজি অফিসের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা লোকসমাজকে বলেন, চলতি বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান কার্যত সফল হয়নি। করোনা ও বন্যার কারণে পরিবেশ অনেকটাই বৈরী ছিল। ফলে এবারও সংগ্রহের টার্গেট পূরণ করা যায়নি। তবে আর এক সপ্তাহ সময় দিলে হয়তো চাল সংগ্রহের টার্গেট পূরণ হতো।