জনসচেতনতার অভাব

0

গতবছর গ্রামে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছিল খুবই কম। তাই তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই সময় কিছুটা নিরাপদে ছিল গ্রামের মানুষ; কিন্তু চলতি বছর ভারতীয় ধরন অর্থাৎ ‘ডেল্টা’ ভ্যারিয়েন্টের কারণে সারা দেশে করোনা সংক্রমণ গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত মৃত্যু এবং সংক্রমণের রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছেÑ সাম্প্রতিক সময়ে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃতদের বেশির ভাগই গ্রামের অধিবাসী।
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর মতে, গত ২০ জুনের পর করোনা সংক্রমণের মাত্রা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। এতে করে এ মহামারীর অতি উচ্চ ঝুঁঁকিপূর্ণ জেলার সংখ্যাও বেড়ে গেছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সিআরআইডিএর মতে, দেশের মোট ৬৪ জেলার ৫৯টিই এ ক্ষেত্রে অতি উচ্চমাত্রায় ঝুঁকিতে রয়েছে। মাত্র পাঁচটি জেলায় এই ভাইরাস সংক্রমণ কিছুটা কম ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যানেও দেশের করোনা পরিস্থিতির একই চিত্র উঠে এসেছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুসারে, শনাক্তের হার ১০ শতাংশ বা এর উপরে হলে সেই জেলাকে ‘উচ্চ ঝুঁঁকিপূর্ণ অঞ্চল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন বাস্তবতায় বলা চলে, পুরো দেশের গ্রামীণ জনপদের অধিবাসীরা বর্তমানে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।
করোনাভাইরাস দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প্রথমত, গ্রামের মানুষ এই ভাইরাসের সংক্রমণ ও ভয়াবহতা সম্পর্কে আজো ততটা সচেতন হয়ে ওঠেনি। গ্রামে সাধারণ বয়স্ক ব্যক্তি অনেকে ‘সামাজিক দূরত্ব’ কী তা-ই জানেন না। কেউ কেউ জানলেও পালনের ব্যাপারে তেমন সচেতন নন। বরং স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে তাদের বড়ই অনীহা দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান। দ্বিতীয়ত, সীমান্ত দিয়ে যখন-তখন চলাচলকারীরা স্বাস্থ্যবিধি মানা ও কোয়ারেন্টিন পালনে একেবারেই উদাসীন। তাদের মাধ্যমে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। তৃতীয়ত, প্রবাসীরাও প্রতিনিয়ত দেশে ফিরছেন; তারাও স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইছেন না। চতুর্থত, ঈদুল আজহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদ উপলক্ষে সরকার আট দিন বিধিনিষেধ শিথিল করায় রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে ফিরতে শুরু করেছেন। গ্রামের বাড়ি যাওয়ায় আগ্রহীরা লঞ্চ-বাসটার্মিনাল, ফেরিঘাট ও রেলস্টেশনে ভিড় করছেন। পরিবহনগুলো করোনা-পূর্বকালের মতোই গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করছে। কেউ স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করছে না। এতে শহরে করোনা মহামারীর সংক্রমণের প্রভাবও নতুন করে গ্রামের মানুষের ওপর গিয়ে আছড়ে পড়তে পারে। প্রবাসীদের সাথে শহর ছেড়ে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া লোকজন যোগ হওয়ায় গ্রামাঞ্চলে করোনাভাইরাস সংক্রমণে অধিক মাত্রা পাবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।
গ্রামে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তবু সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না। এমন একটি ভাইরাস যে দেশব্যাপী ভয়ঙ্কর রূপে আঘাত হেনেছে, সেই কথাটি অনেকে বিশ্বাসই করেন না। এমন মানসিকতার কারণে বাধাহীনভাবে যে যার মতো চলাফেরা করছেন। গ্রামে অনেকের জ্বর সর্দি কাশি থাকলেও টেস্ট করাতে ভোগান্তি পোহাতে হয় বিধায় বেশির ভাগই পরীক্ষা করাতে আগ্রহী নন। অথচ তাদের উপসর্গগুলো দেখে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, তারা করোনায় আক্রান্ত। পরীক্ষা করালে দেখা যাবে, প্রত্যেকেরই করোনা পজিটিভ। অন্য দিকে অসুস্থ যারা তারাও স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। আর যারা সুস্থ তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই নেই। দু-চারজন যারা স্বাস্থ্যবিধি মানার চেষ্টা করছেন তারা অনেকের ব্যঙ্গ বিদ্রƒপ রসিকতার শিকার হচ্ছেন এবং সামাজিকভাবে লজ্জায় পড়ছেন।
আমরা মনে করি, ঈদ উপলক্ষে গ্রামে লোকসমাগম বেড়ে যাওয়ায় করোনা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এটি যাতে না হয়, এর জন্য গ্রামাঞ্চলে অন্তত ১৫ দিন জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে মাঠপ্রশাসনকে ব্যাপকভাবে তৎপর থাকতে হবে। সেই সাথে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে পুলিশ প্রশাসনকেও তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে।