একের পর এক ভয়াবহ আগুন ও প্রাণহানি

0

ফায়ার সার্ভিসের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে জানা যায় গত ছয় বছরে শুধু শিল্পকারখানাতেই ৬ হাজার ৮১টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ২০১২ সালে সাভারের নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস নামের পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে শতাধিক শ্রমিক পুড়ে মরার পর দেশজুড়ে তুমুল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণে আশা করা হয়েছিল নিশ্চিন্তপুর থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আমাদের মগজের নিশ্চিন্তপুরের ঘুম ভাঙবে। দেশের কলকারখানাগুলো শ্রম আইন মেনে যথাযথ বিল্ডিং কোড অনুসরণ করবে এবং শ্রমিকদের সুরক্ষা দেবে। কিন্তু তাজরীন ট্র্যাজেডির প্রায় এক দশকেও পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। এই সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে অগ্নিকা-সহ নানা দুর্ঘটনায় শত শত মৃত্যুই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই ধারবাহিকতায় যোগ হলো রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি।
বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুসের কারখানায় আগুন লেগে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের এই নির্মম মৃত্যু হৃদয় বিদারক। করোনা মহামারীর মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে যে শ্রমিকরা সেখানে কাজ করছিল তারা আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। আগুন লাগার সময় কারখানাটিতে প্রায় দুই শ শ্রমিক ছিল। এর মধ্যে ৫২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ৫০ জনের মতো আহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শরীরের বেশিরভাগই পুড়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিককেই শনাক্ত করা যায়নি। এখন ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। রূপগঞ্জে অগ্নিকান্ডের ঘটনা কলকারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে সেটা শিশুশ্রমের করুণ বাস্তবতা। জানা গেছে, হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের কারখানাটিতে নিয়মিতই চলত শিশুশ্রমিক দিয়ে কাজ করানো। হতাহতদের উল্লেখযোগ্য অংশই শিশু। যেখানে ১১/১২ বছর থেকে ১৫/১৬ বছরের অনেক শিশু শ্রমিক রয়েছে। দেশ রূপান্তরের সরেজমিন অনুসন্ধানে অভিযোগ পাওয়া গেছে দুজন ঠিকাদারের মাধ্যমে ভোলা ও কিশোরগঞ্জ থেকে এই শিশুদের নিয়ে আসা হতো। শিশু শ্রমিকদের বেতনও ধরা হতো খুবই কম আর শিশুদের বড় অংশকেই কারখানার পাশে কোয়ার্টারে রাখা হতো। এক্ষেত্রে অবশ্যই অগ্নিকান্ডের দায়দায়িত্বের পাশাপাশি শিশুশ্রম চালু রাখার দায়ে এই কারখানা কর্তৃপক্ষকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
রূপগঞ্জের ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো যেশিল্পমালিকরা যেমন কলকারখানাগুলোতে শ্রম আইন মানছেন না, তেমনি সরকারের তদারকি সংস্থাগুলোও এ বিষয়ে তাদের দায়দায়িত্ব পালন করছে না। আগের নানা ঘটনার মতো হাসেম ফুডসের এই কারখানাতেও আগুন লাগার পর নিরাপত্তাকর্মীরা প্রধান গেট লাগিয়ে দেয়। এ কারণে নিচতলায় আগুনের সূত্রপাত হলেও প্রাণ বাঁচাতে বাইরে বেরুতে না পেরে শ্রমিকরা ওপরে উঠে যায়। আর কারখানার নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন শ্রমিক ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে নামতে গিয়ে মারা যায়। ফায়ার ব্রিগেডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ ধরনের কারখানায় অন্তত চারটি সিঁড়ি থাকা প্রয়োজন কিন্তু হাসেম ফুডসের কারখানায় ছিল দুটি সিঁড়ি। ফলে শ্রমিকদের সিঁড়ি দিয়ে নামতেও বেগ পেতে হয়েছে। এছাড়া কারখানা ভবনটি যেমন বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি তেমনি সেখানে যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল না। এসব দেখভালের দায়িত্ব শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের। ফলে কারখানা কর্তৃপক্ষ যেমন শ্রম আইন ও বিল্ডিং কোড না মানায় অপরাধী তেমনি সরকারের পরিদর্শকরা অর্পিত দায়িত্ব পালন না করায় অপরাধী। দুটোই ক্রিমিনাল নেগলেজেন্স। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণে তাই উভয়পক্ষকেই বিচারের আওতায় আনতে হবে।
কলকারখানা কিংবা বহুতল ভবন কোনো ক্ষেত্রেই বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। রাজউকের বহুতল ভবনের সংখ্যা আর তার বিপরীতে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্রের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার ভবন ছাড়পত্রহীন। অন্যদিকে, বাণিজ্যিক ও শিল্প ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় স্মোক ডিটেক্টর, ফায়ার ডিটেক্টর, অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার এবং অগ্নিনির্বাপক হোস পাইপ আর জলাধারসহ যেসব বিধিবিধান মানার কথা সেটা যেমন হয় না তেমনি বছরে দুবার এসব পরিদর্শনের বাধ্যবাধকতাও সরকারি সংস্থা যথাযথভাবে করছে না। এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনা একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যেএমন আগুন কেবলই দুর্ঘটনা নয়, কাঠামোগত হত্যাকা-। একদিকে অবকাঠামো নির্মাণ ও আইনি কাঠামো বাস্তবায়নে সরকারের ব্যর্থতা আরেকদিকে শ্রমিকের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দিয়ে মালিক-উদ্যোক্তাদের সীমাহীন মুনাফার লোভ। শ্রমিক আর শিশুরা কি এই দুই আগুনে পুড়েই মারা যাচ্ছে? এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে দেশের শিল্প খাতকে এমন মৃত্যুকূপ থেকে উদ্ধার করতে হবে।