আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তান

0

মাসুম খলিলী॥আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার অনেকটাই চূড়ান্ত পর্যায়ে। বড় কোনো অঘটন না ঘটলে আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের আগেই আমেরিকার যে চার হাজারের মতো সেনা রয়েছে তাদের মধ্যে দেশটির মিশনের নিরাপত্তার জন্য ৫৫০ থেকে ৬৭০ জন রেখে বাকিদের প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। একই সাথে ন্যাটোর সাড়ে সাত হাজার সেনাও প্রত্যাহার করা হবে। এ ব্যাপারে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও সমঝোতা প্রক্রিয়ার প্রধান আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ ওয়াশিংটনে আলোচনা করেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে। আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর কাবুল সরকারের ভাগ্য নিয়েই এতে কথাবার্তা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সমঝোতা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাবুল সরকারের সাথে নয়
এর মধ্যে কাতারের মধ্যস্থতায় আমেরিকা ও তালেবানের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এ আলোচনায় দু’পক্ষের মধ্যে মৌলিক কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে যার ভিত্তিতে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে কাবুলের আশরাফ গনি সরকার একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার ব্যাপারে যে সমঝোতার প্রস্তাব করেছিল তাতে সম্মত হয়নি তালেবান নেতারা। তাদের বক্তব্য হলো, আগে আফগানিস্তান থেকে বিদেশী সেনা সরিয়ে নিতে হবে। এরপর আফগানরা বসে ঠিক করবে আফগানিস্তানের শাসনব্যবস্থা কী হবে।
তালেবানের এই বক্তব্যে মনে হয়, তারা কাবুল সরকারের সাথে আসলে কোনো রাজনৈতিক অংশীদারিত্বের সমঝোতার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। আমেরিকা বা ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের পর কাবুল সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটা এবং কতদিন বহাল থাকবে তা নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষকদের এক সময় ধারণা ছিল, তালেবানদের মোকাবেলা করে বছর দু’য়েক কাবুল সরকার টিকে থাকতে পারবে। তালেবানের সর্বশেষ অগ্রাভিযানের পর ধারণা করা হচ্ছে, মাস ছয়েক সর্বোচ্চ টিকতে পারবে আশরাফ গনির সরকার। তালেবান নেতারাও মনে করছেন, ২০২২ সালের গ্রীষ্মের মধ্যেই তারা চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে সক্ষম হবেন।
আফগানিস্তানে গত দুই দশকের যে যুদ্ধ তার দুটি রূপ রয়েছে। প্রথমত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো আফগানিস্তানে তাদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রকল্পের সাথে আফগান রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনির সরকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো ইঙ্গিত দিয়েছে এই যুদ্ধ এখন শেষ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত পশ্চিমা সমর্থিত গনি সরকার এবং তালেবান বাহিনীর মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধ। এটি আফগানদের মধ্যে একটি যুদ্ধ, যার শেকড় রয়েছে দেশটির অভ্যন্তরীণ জাতিগত প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণার মধ্যে। যুদ্ধের প্রথম রূপটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে গৃহযুদ্ধেরও সমাপ্তি ঘটতে পারত যদি দুই পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা হতো। কিন্তু আফগানিস্তানের প্রধান দুটি পক্ষ আশরাফ গনি এবং তালেবান সরকার জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন বা গৃহযুদ্ধের অবসানের জন্য একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে এখনো রাজি হয়নি।
কাতারের দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে শান্তি আলোচনার এক ধরনের ব্যর্থতা গৃহযুদ্ধের ধারাবাহিকতার ইঙ্গিত বলে অনেকের ধারণা। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সাল থেকে প্রত্যাহারের জন্য গভীর কোনো রাজনৈতিক রোডম্যাপ তৈরি করেনি। যুক্তরাষ্ট্র যেমন করে আকস্মিকভাবে এখানে চলে আসে তেমনিভাবেই বিদায় নেবে বলেই মনে হচ্ছে।
ইতোমধ্যে আফগান সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশের বেশির ভাগ অঞ্চল তাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তালেবানরা তাদের একবারে কোণঠাসা করে রেখেছে। তালেবানরা কাবুল সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আক্রমণ চালানোর আগে আমেরিকার সরে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
তালেবানকে আফগান ভবিষ্যৎ মনে করছে সব পক্ষ?
আফগানিস্তানের সব স্টেকহোল্ডার কার্যত তালেবান আধিপত্য তথা দেশটির ভবিষ্যৎ তালেবান শাসনের বাস্তবতা মেনে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাথে যোগাযোগ ও আলোচনা শুরু করেছে অনেক আগ থেকেই। রাশিয়া ও চীনের সাথেও তালেবানদের আনুষ্ঠানিক- অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রয়েছে। সর্বশেষ ভারতও তালেবানের সাথে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে। কাতারভিত্তিক নেগোসিয়েশন টিমের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এভাবে আফগানিস্তানভিত্তিক সব পক্ষ তালেবানকে পছন্দ করুক বা না করুক দেশটার বাস্তবতা বা ভবিষ্যৎ শাসক হিসেবে তাদের মেনে নিচ্ছে।
গত ৩ জুন আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হানিফ আতমার, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংইয়ি এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি তাদের চতুর্থ ত্রিপক্ষীয় সংলাপ করেছেন। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের পর এটি প্রথম উচ্চস্তরের বৈঠক। মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়ে সরাসরি কোনো উল্লেখ সেখানে পাওয়া যায়নি তবে এটি সভার দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলের প্রেক্ষাপট স্থির করেছিল।
প্রথমত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘদিনের সম্পর্কের উন্নতি করতে ‘গঠনমূলক ভূমিকা’ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন, যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের কারণে আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। চীনের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত চলমান বিশাল অবকাঠামো ও বাণিজ্য প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সাফল্যের জন্য মধ্যএশিয়ায় শান্তি প্রয়োজন। আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান উভয় দেশের সরকারের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এই দেশগুলোর ব্যাপারে চীনের উৎসাহও যথেষ্ট।
দ্বিতীয়ত সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রক্রিয়ায় এই সরকারের সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদেশমন্ত্রীরা আফগানিস্তান এবং এর আশপাশের দেশগুলোতে তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি বা পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক আন্দোলন (ইটিআইএম), আইএসআইএস এবং সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে মোকাবেলায় সম্মিলিতভাবে সম্মত হয়েছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) এর অপারেশনগুলো দুটি দেশের সীমান্ত এলাকায় পরিচালনা হলেও আফগানিস্তানের পাটিকা প্রদেশে এর ঘাঁটি অবস্থিত। চীন ইটিআইএম সম্পর্কে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তানে তাদের কাজ রয়েছে যার বিস্তৃতি জিনজিয়াংয়ের উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। তালেবানরা এই ধরনের সংগঠনকে কোনো তৎপরতা চালাতে না দেয়ার অঙ্গীকার করেছে।
লিবারেল ব্যবস্থার কী হবে?
এখন প্রশ্ন হলো, ২০০১ সালে তালেবান সরকারের পতন ঘটানোর পর আমেরিকা ও তার মিত্ররা আফগানিস্তানে যে লিবারেল একটি ব্যবস্থা চালু করতে চেষ্টা করেছিল তার কী হবে। আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট কাবুল সরকার সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে বিদায় না নিলেও যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে আশরাফ গনির সরকার একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অংশ হওয়ার বিষয়টি তালেবানরা মেনে না নিলে তাদের তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারের হাতে আপসে কর্তৃত্ব হস্তান্তর করতে হবে অথবা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না। এর মধ্যে রাজধানী কাবুল ও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক রাজধানী ও শহর কেন্দ্র ছাড়া আশরাফ গনি সরকারের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সর্বশেষ প্রাদেশিক রাজধানী কুন্দুজের চারপাশে তালেবানরা চলে এসেছে। যেকোনো সময় এর পতন ঘটতে পারে। অন্তত ৫০টি জেলা তালেবানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এবং সেখানে তালেবান প্রশাসন কার্যকর রয়েছে। অন্য জেলাগুলোর শহরবহিভর্‚ত এলাকায় তালেবানরা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ অবস্থায় সরকারি বাহিনীর মনোবল অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। তারা এতদিন যুদ্ধ করে আসছিল ন্যাটোর বিমান সহায়তার উপর ভিত্তি করে। এই সহায়তা বন্ধ হয়ে আসার সাথে সাথে তাদের ভূমি হারানো ক্রমেই বাড়ছে।
পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর সাধারণ আশঙ্কা হলো, তালেবানদের হাতে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে গত ২০ বছরের সব প্রচেষ্টা বিফলে যাবে এবং দেশটিতে কট্টর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এই ধারণার পাশাপাশি দেশটিতে সঙ্ঘাত ও অস্থিরতা নতুন মাত্রা নেবে বলেও আশঙ্কা তাদের। এই আশঙ্কার কিছু ভিত্তিও রয়েছে।
প্রথমত তালেবানরা নিজেদের বেশ খানিকটা উদার সহনশীল ও অন্যদের সাথে যোগসূত্র রক্ষাকারী হিসেবে পরিবর্তিত করেছে। তবে তাদের লক্ষ্য বা আদর্শের মধ্যে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। তালেবান নেতারা এখনো বলছেন, তারা আফগানিস্তানে ইসলামী আমিরাত প্রতিষ্ঠা করবেন যার আদর্শগত ভিত্তি দেউবন্দি ধারার মতো। ফলে তালেবানরা ক্ষমতায় গেলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ সঙ্ঘাতের পরিস্থিতি যে মাত্রাতেই হোক থেকে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ে যেভাবে আফগান মুজাহিদরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সহায়তা লাভ করেছিল একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোবিরোধী লড়াইয়ে তালেবানরা রাশিয়া ও চীনের গোপন সহায়তা লাভ করেছে। স্বাভাবিকভাবে মার্কিন আধিপত্যহীন আফগানিস্তানে চীন রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। আর তালেবানবিরোধী শক্তিকে গোপনে মদদ দিয়ে আবার অস্থির অবস্থা তৈরি করা সহজ হবে।
এসব আশঙ্কার বিপরীতে আশাবাদের জায়গাটি হলো, আফগানিস্তানের সব পক্ষই এখন শান্তি চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র অথবা ভারত যদি সেখানে অস্থিরতায় মদদ দেয় তাহলে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিপন্ন হতে পারে। ভারত গত ২০ বছরে সেখানকার অবকাঠামোতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। যেকোনো পক্ষ অস্থিরতায় মদদ দিলে তালেবানরা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি বিনষ্টকারী শক্তিকে মদদ না দেয়ার যে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়েছে সেটি রক্ষিত নাও হতে পারে।
এছাড়া আরেকটি দিক হলো চীন-রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে যেমন আফগানিস্তানে শান্তি দরকার তেমনিভাবে কয়েকটি শক্তিশালী মুসলিম দেশ বিশেষত পাকিস্তান তুরস্ক ইরান সৌদি আরব আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়ে আনতে আন্তরিকভাবে চাইছে বলে মনে হয়। ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব তুরস্ককে গ্রহণের একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ন্যাটোর অংশ হিসেবে তুরস্কের এই ভূমিকা তালেবানরা গ্রহণ করবে না বলে জানিয়েছে। তুরস্ক এই ভূমিকা অবশ্য শর্তসাপেক্ষে পালনের কথা জানিয়েছে যা ন্যাটোর অংশ হিসেবে না রেখে আফগানিস্তানের কূটনৈতিক অংশীদার দেশ হিসেবে রাখতে চাইতে পারে। তুরস্ক এ ব্যাপারে নতুন যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটি হলো আফগানিস্তানে তারা বাড়তি কোনো সেনা পাঠাবে না। আর বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে পাকিস্তান হাঙ্গেরির সাথে যৌথভাবে। এ মাসের গোড়ার দিকে সৌদি আরব, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের শীর্ষ আলেমদের সাথে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। প্রথমে বিষয়টি গোপন রাখা হলেও পরে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশ করা হয়। ইরানের সাথে তালেবানের যোগাযোগও বেশ কয়েক বছর আগে থেকে চলে আসছে।
এখান থেকে একটি বিষয় মনে হয় যে, আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তুরস্ক ও পাকিস্তানের পাশাপাশি সৌদি আরব ও ইরানের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। তালেবানের কেন্দ্রীয় শূরার মধ্যে শিয়া আলেমও রয়েছেন। আর আমেরিকান ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে কট্টর অবস্থানে তালেবানের প্রতি ইরানের সব সময় সমর্থন ছিল।
তালেবানের শাসনব্যবস্থার রূপ নিয়ে জল্পনা
আফগানিস্তানের স্টেকহোল্ডাররা বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র আর শীর্ষ ওআইসি দেশগুলো দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করার জন্য একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে চায় দেশটিতে। সেই কাঠামো পাশ্চাত্যের মুক্ত ভোটের গণতন্ত্রের মতো নাও হতে পারে। আমেরিকার প্রভাবে যে পদ্ধতি আফগানিস্তানে প্রবর্তন করা হয়েছিল সেটিও মুক্ত ধরনের গণতন্ত্র নয়। লয়া জিরগা নামে যে সংসদ তৈরি করা হয়েছে তা আফগানিস্তানের গোত্রব্যবস্থারই প্রসারিত রূপ। আর নতুন সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রতিটা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েই কমবেশি বিতর্ক হয়েছে। সেই বিতর্কের অবসানের জন্য শেষ দুই মেয়াদে বিজিত প্রার্থীকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দিতে হয়েছে।
তালেবানরা এ পর্যন্ত যেসব অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে সেখানে তারা এক ধরনের প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। তালেবান প্রতিনিধিরা স্থানীয় অভিভাবক তথা গোত্রপতি, ধর্মীয় নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে শূরা প্রতিষ্ঠা করে প্রশাসন পরিচালনা করছে।
এই ধরনের একটি প্রশাসনব্যবস্থা তারা কেন্দ্রীয়ভাবে চালু করতে চাইতে পারে। এর সাথে নির্বাচনব্যবস্থার সমন্বয় করা গেলে ইরান ধরনের থিওলজিভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হতে পারে আফগানিস্তানে।
আমেরিকান সেনামুক্ত আফগানিস্তান অথবা নতুন করে তালেবান শাসনে দেশটির রূপ কী নেবে তা নিয়ে পূর্বানুমান বেশ কঠিন। তবে এখন তালেবানের যে নেতৃত্ব রয়েছে তার সাথে প্রথম দিককার নেতৃত্বের কিছু ব্যবধান রয়েছে। তালেবান আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের প্রভাব ও কর্তৃত্ব ছিল অনেকটা একক। তিনি এখন আর জীবিত নেই। মোল্লা আখুনজাদা এখন তালেবান প্রধান। তিনি পরামর্শপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। আর তালেবানের যেসব নেতা এখন পক্ষগুলোর সাথে আলোচনা ও সমঝোতার বিষয়ে জড়িত তাদের প্রায় সবাই ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ইউরোপ আমেরিকার উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ফলে তালেবানের আগের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এখনকার নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবধান রয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতির বিষয় বেশ ভালো বোঝেন।
তালেবান নেতৃত্ব আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার পুরনো ডকট্রিন এখন সেভাবে লালন করছেন বলে মনে হয় না। এর চেয়ে তারা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ ও প্রতিবেশীদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে দেশ ও জাতির পুনর্গঠনের প্রতি বেশি মনোযোগী হবেন বলে মনে হয়। এটিই বর্তমান আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার-উত্তর আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক।